মো. আহসান হাবীব : বাংলাদেশে এমন বহু আইন রয়েছে যেগুলো শুধু কাগজে কলমেই লিপিবদ্ধ আছে কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ তেমনটা লক্ষণীয় নয় বললেই চলে। তেমনি বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি আইন হলো “ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫”।
এই আইনে পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ বলা থাকলেও আমাদের চারপাশে যে অবস্থা আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি তাতে মনে হয়না যে অত্র আইনটির যথাযথ প্রয়োগ রয়েছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে যেদিকেই তাকান না কেন, সেটা হোক বাস স্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্ট্যান্ড, ফুতপাথ, বাজার, রাস্তাঘাট, আবাসিক এলাকার অলিগলি এমনকি আদালত প্রাঙ্গণও যেন তামাক কিংবা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি ও সেবনের অভয়ারণ্য!
ধূমপান বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, জনগণ এখন এ বিষয়ে কোন তোয়াক্কা না করেই হরহামেশাই যেখানে সেখানে ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় ধূমপান করে যাচ্ছেন। দেখলে মনে হয় যেন পাবলিক প্লেসে ধূমপান না করাটাই তাঁদের কাছে অপরাধ!
তামাক কিংবা তামাকজাত দ্রব্য কি?
মূলতঃ এ সম্পর্কে অত্র আইনের ২(খ) ধারায় বলা হয়েছে যে, “তামাক” অর্থ কোন নিকোটিনা টাবাকাম বা নিকোটিনা রাসটিকার শ্রেণিভুক্ত উদ্ভিদ বা এতদ্সম্পর্কিত অন্য কোন উদ্ভিদ বা উহাদের কোন পাতা বা ফসল, শিকড়, ডাল বা উহার কোন অংশ বা অংশ বিশেষ।
আবার ২(গ) ধারা অনুযায়ী, তামাকজাত দ্রব্য” অর্থ তামাক, তামাক পাতা বা উহার নির্যাস হতে প্রস্তুত যে কোন দ্রব্য, যা চোষণ বা চিবানোর মাধ্যমে গ্রহণ করা যায় বা ধূমপানের মাধ্যমে শ্বাসের সাথে টেনে নেয়া যায় এবং বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, গুল, জর্দ্দা, খৈনী, সাদাপাতা, সিগার এবং হুক্কা বা পাইপের ব্যবহার্য মিশ্রণও (mixture) এর অন্তর্ভুক্ত হবে।
ধূমপান কি?
অত্র আইনের ২(ঘ) ধারায় বলা আছে “ধূমপান” অর্থ কোন তামাকজাত দ্রব্যের ধোঁয়া শ্বাসের সহিত টানিয়া নেওয়া বা বাহির করা, এবং কোন প্রজ্বলিত তামাকজাত দ্রব্য ধারণ করা বা নিয়ন্ত্রণ করাও ইহার অন্তর্ভুক্ত হবে।
আশা করি, এতোক্ষণে তামাক,তামাকজাতদ্রব্য এবং ধূমপান সম্পর্কে সবার পরিষ্কার ধারণা হয়ে গেছে।এবারে দেখবো ধূমপান পাবলিক প্লেসে বা পরিবহনে করা যাবে কি না?তবে তার আগে জানা জরুরি যে পাবলিক প্লেস এবং পরিবহন বলতে কি বোঝানো হবে।
পাবলিক প্লেস কি?
পাবলিক প্লেস বলতে কোন কোন জায়গাকে বুঝাবে সে সম্পর্কে অত্র আইনে কি বলা আছে তা দেখে নেয়া যাক।
আইনের ২(চ) ধারানুযায়ী পাবলিক প্লেস” অর্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, আধা-সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও বেসরকারি অফিস, গ্রন্থাগার, লিফট, আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্র (indoor work place), হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, আদালত ভবন, বিমানবন্দর ভবন, সমুদ্রবন্দর ভবন, নৌ-বন্দর ভবন, রেলওয়ে স্টেশন ভবন, বাস টার্নিমাল ভবন, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণী ভবন, চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেট, শিশুপার্ক, মেলা বা পাবলিক পরিবহনে আরোহণের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সারি, জনসাধারণ কর্তৃক সম্মিলিতভাবে ব্যবহার্য অন্য কোন স্থান অথবা সরকার বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক, সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা, সময় সময় ঘোষিত অন্য যে কোন বা সকল স্থান;
২(ছ) ধারা অনুযায়ী “পাবলিক পরিবহণ” বলতে বুঝায় মোটর গাড়ী, বাস, রেলগাড়ী, ট্রাম, জাহাজ, লঞ্চ, যান্ত্রিক সকল প্রকার জন-যানবাহন, উড়োজাহাজ এবং সরকার কর্তৃক, সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, নির্দিষ্টকৃত বা ঘোষিত অন্য যে কোন যান;
ধূমপান এলাকা
প্রশ্ন হতে পারে ধূমপান তাহলে করবে কোথায়? এ সম্পর্কে আইনে কিছু বলা আছে? হ্যাঁ, অবশ্যই বলা আছে। অত্র আইনের ২(ঙ) এবং ৭, ৭ক ধারায় এ সম্পর্কে ইশারা ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। ২(ঙ) ধারা অনুযায়ী “ধূমপান এলাকা”বলতে বুঝাবে কোন পাবলিক প্লেস বা পাবলিক পরিবহণে ধূমপানের জন্য নির্দিষ্টকৃত কোন এলাকা।
৭ ধারা অনুযায়ী, কোন পাবলিক প্লেসের মালিক, তত্ত্বাবধায়ক বা নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি বা ব্যবস্থাপক উহাতে এবং কোন পাবলিক পরিবহণের মালিক, তত্ত্বাবধায়ক, নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি বা ব্যবস্থাপক উহাতে ধূমপানের জন্য স্থান চিহ্নিত বা নির্দিষ্ট করিয়া দিতে পারিবেন। তবে ধূমপানের অমন স্থানের সীমানা,বর্ণনা সরঞ্জাম এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্র আইনের বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে।
৭(ক) ধারায় বলা হয়েছে যে (১) এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, প্রত্যেক পাবলিক প্লেস বা পাবলিক পরিবহনের মালিক, তত্ত্বাবধায়ক, নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি বা ব্যবস্থাপক বিধি দ্বারা নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করবেন। (২) উপ-ধারা (১) এর অধীন প্রণীত বিধির বিধান লঙ্ঘন করিলে তিনি অনধিক পাঁচশত টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
পাবলিক প্লেসে এবং পাবলিক পরিবহনে ধূমপান শাস্তিযোগ্য অপরাধ
অত্র আইনের ৪(১) ও (২)উপধারায় বলা হয়েছে যে, ধারা ৭ এর বিধান সাপেক্ষে, কোন ব্যক্তি কোন পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহণে ধূমপান করতে পারবেন না৷
উল্লেখ্য যে, অত্র আইনটি ২০১৩ সালে সংশোধন করে ২ উপধারা নিয়ে আসা হয় যেখানে বলা হয়, কোন ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর বিধান লঙ্ঘন করিলে তিনি অনধিক তিনশত টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং উক্ত ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ একই ধরণের অপরাধ সংঘটন করলে তিনি পর্যায়ক্রমিকভাবে উক্ত দণ্ডের দ্বিগুণ হারে দণ্ডনীয় হবেন।
লেখক : অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট, ঢাকা; শিক্ষক, ভার্চ্যুয়াল ল’ একাডেমি বাংলাদেশ।