বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রকাশের দিনকে ‘জনগণতন্ত্র দিবস’ হিসাবে পালনের দাবি উঠেছে। একাত্তরে ওই ঘোষণাপত্র প্রণয়নকারী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল-ইসলামসহ কয়েকজন বক্তা সোমবার (১০ এপ্রিল) ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে এ দাবি জানান।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (বিলিয়া) আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমীর-উল-ইসলাম বলেন, “আমি বিশ্বাস রাখি, ১০ই এপ্রিল, যেদিন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, সে দিনটি রিপাবলিক ডে বা জনগণতন্ত্র দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পাবে।”
‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার’- এই তিনটি আদর্শিক মূল্যবোধকে তুলে ধরার পাশাপাশি বাস্তবভিত্তিক ঘটনার বিবরণ ঘোষণাপত্রে দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন প্রবীণ এই আইনজীবী।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ নামের যে রাষ্ট্রের জন্ম হয় মুজিবনগরে, তার সাংবিধানিক ভিত্তি হচ্ছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রই হচ্ছে বাংলাদেশের ‘জন্ম সনদ’।
একাত্তরের সেই দিন নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা (এমএনএ এবং এমপিএ) ভারতের আগরতলায় একত্রিত হয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। প্রণীত হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র।
সেই ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার (মুজিবনগর সরকার) শপথ গ্রহণ করে এবং নয় মাস যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে।
ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশের পরবর্তী সকল সরকার হচ্ছে এই প্রথম সরকারের ধারাবাহিক উত্তরাধিকারী। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটিতে লিপিবদ্ধ করা হয় যে, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকমূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং এইরূপ বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সনের ২৬ শে মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।”
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের দলিলটির কখনোই সংশোধন বা সংযোজনের করা সম্ভব নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এই দলিল অমর ও চিরন্তন, যতদিন বাংলাদেশ থাকবে এই দলিলও ততদিন অটুট থাকবে। তাই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়েও কোনো বিতর্কের অবকাশ নাই।
“এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি ‘গণপরিষদ’ গঠন করেন এবং বঙ্গবন্ধুর ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন দেন।”
তবে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন।
মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের এই আয়োজক বলেন, “বাঙালির মুক্তির দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এসেছে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, যার কেন্দ্রে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
“ডিফ্যাক্টো স্বাধীনতা কিন্তু ৭ মার্চই ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল। সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহে আমরা তা দেখেছি। এরপর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সামগ্রিক সবকিছু তা নয়। এটা কমপ্লিট কিছু না। সমাজের একটা বিবর্তন, আন্দোলন তার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে।”
একাত্তরে পাকিস্তানের দুই অংশের মাথাপিছু আয়ের তুলনা করে মুক্তিযুদ্ধের এই সাব-সেক্টর কমান্ডার বলেন, “১৯৭১ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল পাকিস্তানের অর্ধেক। পাকিস্তানের ছিল প্রায় দুইশর কাছাকাছি, আমাদের ছিল একশর নিচে। ৭৫ সালে হয়ে হয়ে গেল ২০০ মার্কিন ডলার আর পাকিস্তান পিছে পড়ে গেল। তারপর দেড় যুগ এটার যাত্রা ব্যাহত হল।”
এখন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সব সূচকে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার কথা তুলে ধরে তৌফিক-ই-ইলাহী বলেন, “যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা স্বাধীন করেছি, সব স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক দুর্যোগের মধ্যেও স্বাধীনতার সুফলগুলো সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, সেটা হল আমাদের বড় অর্জন।”
ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ তাত্ত্বিক কোনো বিষয় ছিল না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা একটু মশকরা করে পশ্চিম পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তাদের বলতাম যে ভাই, ধর্ম যদি ভিত্তি হবে, তোমরা ইরান আফগানিস্তানকে প্রথম অ্যাটাক শুরু কর, এক হাজার মাইল দূরে গিয়ে আমাদের দিকে হাত বাড়ানোরতো দরকার নাই। যেখানে আমরা অন্য সব দিকে তোমাদের চেয়ে আলাদা।
“এটার কোনো উত্তর ছিল না। এটা পাকিস্তান সরকারের একটা বুলি ছিল, এটা তাত্ত্বিক কোনো কিছু ছিল না। আপনি যদি মনে করেন যে, জিন্নাহর একটি তাত্ত্বিক বিষয় ছিল না, এটা কনফিডেন্সের ব্যাপার ছিল। যার যার নিজের স্টেটকে গ্রহণ করার ব্যাপার ছিল।”
অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন অনুষ্ঠানে বলেন, “১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল দৈবিকভাবেই যেন অনেককিছু হয়ে গেল। ২৫ মার্চের রাতে ১২টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন।
“তাজউদ্দিন আহমদ এবং ব্যরিস্টার এম আমীর-উল-ইসলাম জুটিবদ্ধ হলেন এবং ঐতিহাসিক সব ভূমিকা রাখলেন। আমি মনে করি ১০ এপ্রিল গণরাষ্ট্র দিবস হিসেবে পালিত হওয়া উচিত।”
আলোচনায় যোগ দিয়ে ঢাকায় ভারতের সাবেক হাই কমিশনার বীনা সিক্রি বলেন, “৬ দফার ঘোষণার পর স্বাধীনতার বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় বিষয়টি আরও জোরদার করে। আর ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুতো সব বলেই দিলেন।
“২৫ মার্চের রাতের ঘটনা ছিল শকিং। ভারত পুরো অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছিল। সেই সময়ে ভারতের সব রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ বাংলাদেশকে সমর্থন করেছিল। ২৫ মার্চের পর কেউ ইস্ট পাকিস্তান উচ্চারণ করেনি, করেছে ইস্ট বেঙ্গল।”
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় সেনানী এবং ‘ফ্রম ইস্ট পাকিস্তান টু বাংলাদেশ’ গ্রন্থের রচয়িতা ব্রিগেডিয়ার আর পি সিং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্মৃতিচারণ করেন অনুষ্ঠানে।
মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণের সময় মেহেরপুরে দায়িত্ব পালন করা মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের সকল মানুষের।
“এটা এতটাই শক্তি যুগিয়েছিল যে, পাকিস্তানিরা বাংলাদেশে তাদের ক্যন্টনমেন্টেও নিরাপদ ছিল না। আর এর সবকিছু সম্ভব হয়েছিল কারণ নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ অনুষ্ঠানে বলেন, “কতটা বুদ্ধিমত্তা এবং প্রজ্ঞা থাকলে সেই সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়েছিল, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯৭১ সালে এদেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছে, যুদ্ধ করেছে। সেই সময়ে ভারতের মানুষ, সরকার এবং সৈনিকরা বিরাট অবদান রেখেছেন। আমরা সেটি সবসময় মনে রাখি।”
‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র: ১০ এপ্রিল ১৯৭১ এবং একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম’ শীর্ষক দুদিনব্যাপী এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে বিলিয়া। একইস্থানে আজ মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) হবে দ্বিতীয় দিনের আয়োজন।