মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী : আদালতের আদেশ অমান্য করায় এবং আদালতে মিথ্যা মেডিকেল রিপোর্ট দাখিল করায় কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মো: মাহবুবুর রহমান সহ ৫ চিকিৎসককে আদালতে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজারের উখিয়া আমলী আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আসাদ উদ্দিন মোঃ আসিফ এ আদেশ দিয়েছেন।
আদালতে তলব করা অপর ৪ চিকিৎসক হচ্ছেন- কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অর্থো সার্জারী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আয়ুব আলী, কক্সবাজার বক্ষব্যাধি ক্লিনিকের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর, কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (RMO) ডা. মুহাম্মদ আশিকুর রহমান এবং কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. ইমরুল কায়েস।
কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশেক এলাহী শাহজাহান নুরী ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি আরো জানান, কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালীর ১৮ নম্বর রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পের শরনার্থী জাকের প্রকাশ শাকের কে ২০২২ সালে ১৬ ডিসেম্বর হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিহত জাকের প্রকাশ শাকের এর স্ত্রী মোস্তফা বেগম বাদী হয়ে ৮ জন কে এজাহারভুক্ত এবং ৪/৫ জন অজ্ঞাত আসামী উল্লেখ করে উখিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার উখিয়া থানা মামলা নম্বর : ৩৫/২০২২ ইংরেজি এবং জিআর মামলা নম্বর : ১৪৭৪/২০২২ ইংরেজি (উখিয়া)।
উক্ত মামলায় কক্সবাজারের টেকনাফের ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শরনার্থী মোহাম্মদ সালেহ প্রকাশ সালামের পুত্র মোহাম্মদ খায়রুল আমিন প্রকাশ হারুন (২৬) কে গত ২৪ জানুয়ারী সন্দেহজনক আসামী হিসাবে গ্রেফতার করা হয়।
মোহাম্মদ খায়রুল আমিন প্রকাশ হারুনকে গ্রেপ্তারের পর গত ২৬ জানুয়ারী উখিয়া আমলী আদালতে আনা হলে সে বিচারক আসাদ উদ্দিন মোঃ আসিফ এর সামনে করুণ আর্তনাদে কেঁদে উঠে। বিচারক কান্নার কারণ জানতে চাইলে হারুন জানায়, তাকে উখিয়া থানায় অমানুষিকভাবে বেদম মারধর করা হয়েছে। আদালতে হারুন তার পরনের লুঙ্গি খুলে পাচার আঘাত, হাতের কনুই এবং কব্জির আঘাত দেখায়। এসময় বিচারক হরুনের বাম হাতের কব্জি ও কনুই ফুলা, মারধরের কারণে কোমর হালকা বাঁকা প্রকৃতি হয়ে যওয়া, পাচার উভয় পাশে নীলা, ফুলা আঘাতের চিহ্ন ও কালো রং এর রক্ত জমাট দেখতে পান।
হারুনের শরীরে আঘাত গুলো দেখে তাকে লাটি দ্বারা উপর্যুপরি ব্যাপক আঘাত করা হয়েছে বলে আদালত মনে করেন। তখন হারুন স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে চাইলে আদালত তার কাছ থেকে ৪ পৃষ্ঠা জবানবন্দি গ্রহণ করেন। হারুনের জবানবন্দি গ্রহণকালে আদালতে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
২৬ জানুয়ারী আদালত হারুনের শরীরের এ পৈশাচিক অবস্থা দেখে হারুনকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা সেবা দিতে এবং ৩ সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল বোর্ড গঠন পূর্বক হারুনের শারীরিক পরীক্ষা করে পরবর্তী ৩ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ২৯ জানুয়ারীর মধ্যে আদালতে রিপোর্ট দাখিল করার জন্য বিচারক আসাদ উদ্দিন মোঃ আসিফ কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মোঃ মাহবুবুর রহমানকে নির্দেশ দেন। একইসাথে আসামী হারুন সুস্থ হলে বিধি অনুসরণ করে তাকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেওয়া হয়।
হারুনকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য ২৬ জানুয়ারী কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হলেও কক্সবাজারের সিভিল সার্জন হারুনের শারীরিক পরীক্ষার জন্য কোন মেডিকেল বোর্ড গঠন করেননি এবং আদালতে ২৯ জানুয়ারীর মধ্যে কোন রিপোর্টও জমা দেননি।
আদালত আবারো হারুনের শারীরিক পরীক্ষা করে পরবর্তী ২ দিনের মধ্যে আদালতে রিপোর্ট দাখিল করার জন্য বিচারক গত ২ ফেব্রুয়ারী সিভিল সার্জনকে পুনরায় নির্দেশ দেন। সিভিল সার্জন আদালতের এ নির্দেশও কার্যকর করেননি।
পরে ৬ ফেব্রুয়ারী সিভিল সার্জন ডা. মোঃ মাহবুবুর রহমান কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অর্থো সার্জারী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আয়ুব আলীকে সভাপতি, কক্সবাজার বক্ষব্যাধি ক্লিনিকের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর, কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (RMO) ডা. মুহাম্মদ আশিকুর রহমান এবং কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. ইমরুল কায়েসকে সদস্য করে ৪ সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল বোর্ড গঠন পূর্বক ৮ ফেব্রুয়ারী হারুনের শারীরিক পরীক্ষার নির্দেশ দেন।
আদালতের আদেশের দীর্ঘ ১৪ দিন পর ৮ ফেব্রুয়ারী মেডিকেল বোর্ড হারুনের শারীরিক পরীক্ষা করেন এবং ৯ ফেব্রুয়ারী আদালতে রিপোর্ট দাখিল করেন। আদালতে সিভিল সার্জন কর্তৃক প্রেরিত মেডিকেল বোর্ডের রিপোর্টে দেখা যায়, ৩১ জানুয়ারী এবং ৮ ফেব্রুয়ারী আসামী হারুনকে ২ বার শারীরিক পরীক্ষা করা হয়েছে।
বিচারক আসাদ উদ্দিন মোঃ আসিফ সিভিল সার্জন কর্তৃক আদালতে প্রদত্ত মেডিকেল রিপোর্ট পর্যালোচনা করে গত ১২ ফেব্রুয়ারী তাঁর আদেশে বলেন, ৩১ জানুয়ারী মেডিকেল বোর্ড গঠন না করা সত্ত্বেও কোন আদেশের প্রেক্ষিতে, কিভাবে হারুনের শারীরিক পরীক্ষা করা হলো, তা বোধগম্য নয়।
আদালতের আদেশে বলা হয়, হারুনকে শারীরিক পরীক্ষা না করে মেডিকেল বোর্ড পরীক্ষার মিথ্যা রিপোর্ট তৈরী করেছেন এবং সিভিল সার্জন সেই মিথ্যা রিপোর্ট আদালতে প্রেরণ করেছেন।
২৬ জানুয়ারী আসামী হারুনকে আদালতে উপস্থাপনকালে তাকে বেদম মারধর করার যে ভয়াবহ চিহ্ন তার শরীরে দৃশ্যমান ছিল, দীর্ঘ ১৪ দিন বিলম্বে হারুনের শারীরিক পরীক্ষা করায় চরম নির্যাতনের সে চিহ্ন স্বাভাবিকভাবে হারুনের শরীরে আর দৃশ্যমান থাকার কথা নয় বলে আদালত তাঁর আদেশে উল্লেখ করেন।
আদালত আদেশে আরো বলেন, ন্যায় বিচার পাওয়া সকল নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। আসামী হারুনকে ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত করার কোন সুযোগ আইনে বিদ্যমান নেই। সিভিল সার্জন ডা. মোঃ মাহবুবুর রহমান চিকিৎসক হিসাবে তা জানা থাকা সত্বেও অসৎ উদ্দেশ্যে এবং উদ্দেশ্যে প্রণোদিতভাবে ভিকটিম হারুনকে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করেছেন।
বিচারক বলেন, সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান আদালতের আদেশ অমান্য করে বিচার ব্যাবস্থা, আইন ও আদালতের প্রতি চরম ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছেন। এধরণের ধৃষ্ঠতা প্রদর্শনকারী কর্মচারীকে ক্ষমা প্রদর্শন করা হলে দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যাবে।
এ অবস্থায় কোন ক্ষমতা বা আদেশ মতে, মেডিকেল বোর্ড ৩১ জানুয়ারী আসামী হারুনের শারীরিক পরীক্ষা করেছেন, আর ৩১ জানুয়ারী যদি পরীক্ষা করা না হয়ে থাকে, তাহলে আদালতে পরীক্ষার মিথ্যা রিপোর্ট প্রেরণ করায় মেডিকেল বোর্ডের উল্লেখিত ৪ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ফৌজদারী ব্যাবস্থা গ্রহণ এবং বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা নিতে কেন আদেশ দেওয়া হবেনা, তৎমর্মে আদালতে আগামী ২ মে বোর্ডের ৪ চিকিৎসককে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে গত ২৬ জানুয়ারী দেওয়া আদালতের আদেশ মতে, সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান কেন মেডিকেল বোর্ড গঠন করেননি, পরবর্তী ৩ দিনের মধ্যে আদালতে হারুনকে পরীক্ষার মেডিকেল রিপোর্ট কেন প্রেরণ করেননি, মেডিকেল বোর্ড গঠন নাকরেও ৩১ জানুয়ারী আসামী হারুনকে পরীক্ষা না করে শারীরিক পরীক্ষার মিথ্যা রিপোর্ট আদালতে প্রেরণ করায় সিভিল সার্জন এর বিরুদ্ধে ফৌজদারী ব্যাবস্থা গ্রহণ এবং বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা নিতে আদেশ দেওয়া হবেনা, তৎমর্মে আদালতে আগামী ১৬ মে সিভিল সার্জন ডা. মোঃ মাহবুবর রহমানকে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, গত ২৬ জানুয়ারী আসামী হারুনকে আদালতের নির্দেশে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য তাকে গ্রহণ ও ভর্তি করানোর তথ্য, হারুনকে হাসপাতালে শারীরিকভাবে কি অবস্থায় পেয়েছিলেন, তার শরীরে আঘাতের কি ধরনের চিহ্ন ছিল, তার বিস্তারিত বর্ননা, তাকে কি চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে, ভর্তি রেজিস্ট্রারের সত্যায়িত কপি, আনুষাঙ্গিক সকল কাগজপত্র আদালতে দাখিল করার জন্য কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) কে উখিয়া আমলী আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আসাদ উদ্দিন মোঃ আসিফ নির্দেশ দিয়েছেন।
আদালতের আদেশের কপি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মোঃ মাহবুবুর রহমান, কক্সবাজারের জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার এবং মেডিকেল বোর্ডের ৪ জন চিকিৎসককে প্রেরণ করতে বলা হয়েছে।
কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশেক এলাহী শাহজাহান নুরী জানান, আদালতের নির্দেশ মতে সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে ইতিমধ্যে আদালতের আদেশের কপি প্রেরণ করা হয়েছে।