মোঃ কামাল হোসেন : রহিম সাহেব ও করিম সাহেব একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। রহিম সাহেব পারিবারিক প্রয়োজনে একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে চাকরির বেতনের বিপরীতে ঋণ গ্রহণ করেন। ঋণ গ্রহণের সময় করিম সাহেবকে উক্ত ঋণের জামিনদার করেন। সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার কারণে করিম সাহেব জামিনদার হতে মানা করতে পারেননি।
পরবর্তীতে বদলি জনিত কারণে তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন কোনো যোগাযোগ নেই। এক মাস আগে সেই ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা করিম সাহেবকে ফোন দিয়ে জানায় যে, রহিম সাহেব যে ঋণ গ্রহণ করেছেন তা পরিশোধ করেননি এবং ঋণখেলাপি হয়েছেন। ব্যাংক তার কাছে সুদসহ অনেক টাকা পাওনা রয়েছে।
ব্যাংকের কর্মকর্তা জামিনদার হওয়ার কারণে সহকর্মীর ঋণের টাকা তাকে পরিশোধের জন্য জানান ও তার নামে মামলা করারও হুমকি প্রদান করেন। ঋণ পরিশোধ না করলে কর্মক্ষেত্রেও সমস্যা হবে জানান। বিষয়টি নিয়ে করিম সাহেব খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েন।
উপরের ঘটনাটি আমাদের দেশে প্রায়শই দেখা যায়। ঋণগ্রহিতা ঋণ গ্রহণ করে তা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় বা নিরুদ্দেশ হন আর সেই ঋণের বোঝা এসে পড়ে জামিনদারের উপর।
জামিনদারি চুক্তির মানে হলো ঋণদাতা ও একজন জামিনদারের মধ্যে অন্য কোন ব্যক্তির নেয়া ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তা বিধানের চুক্তি। অর্থাৎ ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে জামিনদার সেই ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবেন। কোন বিপরীতধর্মী ইচ্ছা ব্যক্ত করা না হলে, জামিনদারের বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকবে ঋণের মূল অংক, মূল অংকের ওপর সৃষ্ট সুদ, ঋণদাতার কোন ক্ষতি হলে তার ক্ষতিপূরণ এবং ঋণের মূল অংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যয়।
যিনি ঋণের জামিনদার হবেন ঋণগ্রহিতার অপারগতায় বা ব্যর্থতায় জামিনদারকেই সেই ঋণ শোধ করতে হবে। কেননা তিনি জামিনদার হয়েছেন বলেই ঋণগ্রহীতা ঋণ মঞ্জুরী পেয়েছেন, নইলে পেতেন না। জামিনদারকে এ বিষয়টা পরিস্কারভাবে বুঝতে হবে। তবে জামিনদার বিনিয়োগ গ্রহীতা এর নিকট থেকে আদায়ের শর্তে তা পরিশোধ করতে পারবেন।
যে কোন ধরনের ঋণ প্রদানের সময় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ আদায়ের নিরাপত্তার স্বার্থে বেশ কিছু ডকুমেন্টস সম্পাদন করে থাকে। পারসোনাল গ্যারান্টি বা ব্যক্তিগত জিম্মানামা এ ধরনের একটি চার্জ ডকুমেন্ট। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণের বিপরীতে জামানত হিসাবে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই জামিনদার বা গ্যারান্টর হিসাবে এক বা একাধিক ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। ঋণখেলাপি হলে গ্যারান্টরের উপরও দায় বর্তায় ঋণ পরিশোধের জন্য। আর সে জন্যই গ্যারান্টরও ঋণখেলাপি হন, যদিও তিনি ঋণ নেন নাই।
অর্থ ঋণ আদালত আইন ২০০৩ এর ধারা ৬(৫)-অনুসারে “আর্থিক প্রতিষ্ঠান মূল ঋণ গ্রহীতার (Principal debtor) বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার সময়, তৃতীয়পক্ষ বন্ধকদাতা (Third party mortgagor) বা তৃতীয়পক্ষ গ্যারান্টর (Third party guarantor) ঋণের সহিত সংশ্লিষ্ট থাকিলে, উহাদিগকে পক্ষ করিবে; এবং আদালত কর্তৃক প্রদত্ত রায়, আদেশ বা ডিক্রি সকল বিবাদীর বিরুদ্ধে যৌথভাবে ও পৃথক পৃথক ভাবে (jointly and severally) কার্যকর হইবে এবং ডিক্রি জারির মামলা সকল বিবাদী-দায়ীকের বিরুদ্ধে একই সাথে পরিচালিত হইবে।
তবে শর্ত থাকে যে, ডিক্রী জারীর মাধ্যমে দাবী আদায় হওয়ার ক্ষেত্রে আদালত প্রথমে মূল ঋন গ্রহীতা-বিবাদীর এবং অতঃপর যথাক্রমে তৃতীয় পক্ষ বন্ধক দাতা (Third party mortgagor) ও তৃতীয় পক্ষ গ্যারান্টর (Third party guarantor) এর সম্পত্তি যতদূর সম্ভব আকৃষ্ট করিবে।
আরও শর্ত থাকে যে, বাদীর অনুকূলে প্রদত্ত ডিক্রির দাবি তৃতীয় পক্ষ বন্ধক দাতা (Third party mortgagor) অথবা তৃতীয় পক্ষ গ্যারান্টর (Third party guarantor) পরিশোধ করিয়া থাকিলে উক্ত ডিক্রি যথাক্রমে তাহাদের অনুকূলে স্থানান্তরিত হইবে এবং তাহারা মূল ঋণ গ্রহীতার বিরুদ্ধে উহা প্রয়োগ বা জারি করিতে পারিবেন।”
অর্থাৎ আপনি ঋণ গ্রহণ না করেও শুধুমাত্র ঋণের জামিনদার হওয়ার কারণে আপনাকে সেই ঋণ পরিশোধ করতে হতে পারে এবং এর ব্যর্থতায় আপনার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের হতে পারে। সুতরাং কারো ঋণের জামিনদার হওয়ার আগে নিজের পকেটে হাত দিয়ে দেখুন ঐ ঋণের টাকা অন্যান্য চার্জসহ পরিশোধে আপনার সামর্থ্য আছে কিনা? সামর্থ্য না থাকার অজুহাতে কিংবা আমি ঋণের কোন অংশ ভোগ করিনি এ অজুহাতে আইন কখনোই আপনাকে রেহাই দেবে না।
লেখক : উপ-ব্যবস্থাপক (আইন), বিজিডিসিএল, কুমিল্লা। ই-মেইল kamallawru@gmail.com