কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা প্রত্যেক শ্রমিকের আইনগত অধিকার বলে মন্তব্য করেছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। এ অধিকার বাস্তবায়নে শোভন, সুষ্ঠু ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণের কোনো বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
‘জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবস’ উপলক্ষে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে শুক্রবার (২৮ এপ্রিল) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এ সভার আয়োজন করে। এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘নিশ্চিত করি শোভন কর্মপরিবেশ, গড়ে তুলি স্মার্ট বাংলাদেশ।’
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষাবিধি পালন, শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণ অত্যন্ত গরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে পেশাগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা বর্তমানে কেবল সরকার বা কারখানার মালিকপক্ষের ইচ্ছের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণকে কেবল মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ নেই। এটি এখন কারখানা মালিকপক্ষের জন্য দায়বদ্ধতায় পরিণত হয়েছে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন ও বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালার ভিত্তিতে কর্মক্ষেত্র শ্রমিক ভাই-বোনদের জন্য নিরাপদ ও শোভন রাখতে হবে, এটি এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশ যেভাবে উন্নত বিশ্বের অভিমুখে যাত্রা করেছে, সেখানে পেশাগত সুরক্ষার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। বর্তমানে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা পালনকে জাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
‘স্বাধীনতার পর তৎকালীন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কলকারখানাগুলো জাতীয়করণের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আনিসুল হক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সময়োচিত সেই পদক্ষেপের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল কারখানাগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, শ্রমজীবী মানুষের পেশাগত সুরক্ষা ও আইনগত অধিকার নিশ্চিত করা। বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শকে অনুসরণ করেই বর্তমান সরকার দেশের সব খাতের শ্রমজীবী মানুষের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নানাবিধ কল্যাণমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।’
আনিসুল হক বলেন, ‘জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন এবং ২০৪১ সালে স্মার্ট ও উন্নত দেশের কাতারে সামিল হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে সরকার ব্যাপক উন্নয়ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে দেশের মেহনতি ও শ্রমজীবী মানুষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এজন্য শ্রমিক ভাই-বোনদের জন্য শোভন কর্মপরিবেশে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করার বিষয়টি সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দপ্তর ও সংস্থাকে বাংলাদেশে শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।’
‘এরই মধ্যে বাংলাদেশে শিল্প-কারখানা বেড়েছে কয়েকগুণ। তৈরি হয়েছে অসংখ্য নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র। দেশের রপ্তানি বাণিজ্য আজ বিশ্বব্যাপী বিকাশ লাভ করেছে। রপ্তানি বাণিজ্যের বাজার ধরে রাখার পাশাপাশি আরও বিস্তৃত করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমমান অনুযায়ী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা ও কর্মক্ষেত্রে কল্যাণমূলক ব্যবস্থাগুলো নিশ্চিত করাসহ উৎপাদনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানের মালিক, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, শ্রমিক সংগঠন, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সম্মিলিতভাবে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং কর্মক্ষেত্রে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।’
‘শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণের জন্য বাংলাদেশ শ্রম আইন এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালার যথাযথ প্রয়োগসহ সব অংশীজনের সম্মিলিত উদ্যোগের বাস্তবায়ন আবশ্যক। শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে শ্রমিক, মালিক, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে আন্তরিকভাবে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, ‘সরকার বাংলাদেশ লেবার ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রকল্পের আওতায় সারাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সব শ্রমিককে ডাটাবেজের অন্তর্ভুক্ত করার কাজ শুরু করেছে। মন্ত্রণালয়ের এটি একটি মহতি উদ্যোগ।’
তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের সার্বজনীন পেনশন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা শ্রম বিধিমালা-২০১৫ কে যুগোপযোগী করে ২০২২ সালে সংশোধন করেছি। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০১৩ ও ২০১৮ সালে সংশোধন করেছি। শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশ শ্রম আইন আবারও সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি। সংশোধিত এ শ্রম আইন অর্থনৈতিক অঞ্চলেও কার্যকর হবে। ইপিজেড এলাকায় শ্রমিকদের জন্য শ্রম বিধিমালা কার্যকর করা হয়েছে, হেল্পলাইন চালু করা হয়েছে এবং এ এলাকায় শ্রম পরিদর্শনের মান বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ইপিজেড এলাকায় আমাদের শ্রম পরিদর্শকরা পরিদর্শন করছেন। আমাদের এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষের জন্য পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি নিশ্চিত হবে বলে আমি আশাবাদী।’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলার কারণে বাংলাদেশ জাতিসংঘ কর্তৃক স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। এ অর্জনে এদেশের শ্রমজীবী মানুষের অবদান অপরিসীম। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সরকারের সাথে মালিক ও শ্রমিক সবাইকে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শ্রমিক ভাই-বোনদের জন্য পেশাগত স্বাস্থ্য, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সেফটি নিশ্চিত করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলব। জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি দিবস ২০২৩ এ এ হোক আমাদের অঙ্গীকার।’
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. এহছানে এলাহীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক মো. নাসির উদ্দীন আহমেদ, শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী, কানাডিয়ান হাইকমিশনের হেড অব কো-অপারেশন জো গুডিংস, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কান্ট্রি ডিরেক্টর তোমো পুটিআইনেন, বাংলাদেশ এমপ্লোয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি আরদাশির কবির, শ্রমিক লীগের সভাপতি নুর কুতুব আলম মান্নান প্রমুখ।