মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিলে আদালতে দাঁড়াতে পারবেন না আইনজীবী
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন

চূড়ান্ত রায়ের পর ফাঁসি স্থগিতে রিট আদালত অবমাননা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যা মামলায় একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও নিহত ড. তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলমের ফাঁসি বহাল রেখেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সম্প্রতি আসামিদের রিভিউ আবেদন খারিজের রায় প্রকাশিত হয়।

পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ফলে দুই ফাঁসি কার্যকরে আইনগত কোনো বাধা ছিলনা। তাদের সামনে শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ ছিল। তবে মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের স্ত্রী ইসরাত রহমান ও জাহাঙ্গীর আলমের ভাই মিজানুর রহমান এই দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর স্থগিত চেয়ে হাইকোর্ট রিট দায়ের করেছেন।

আপিল বিভাগ ফাঁসি বহাল রাখার পরও এ মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া দুই আসামির হাইকোর্টে রিট করা আদালত অবমাননার সমান বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।

আজ সোমবার (৮ মে) সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, “আপিল বিভাগ ফাঁসি বহাল রাখার পরও তাদের (আসামিদের) হাইকোর্টে রিট করা আদালতকে একরকম অসম্মান করা। এখন আর তাদের কিছুই করণীয় নেই। শুধু তারা এটুকু করতে পারে, মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়া।”

এর আগে গতকাল রোববার (৭ মে) দুই আসামির একজনের ভাই এবং অপরজনের স্ত্রী ফাঁসি কার্যকর স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। রিটকারীদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

আসামি পক্ষের আইনজীবী তাজুল ইসলাম জানান, আসামিদের আটক, গ্রেপ্তার ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণে সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার ব্যত্যয় হয়েছে। তাই এক আসামির ভাই ও আরেক আসামির স্ত্রী পৃথক রিট আবেদন করেছেন। রিটে ফাঁসি কার্যকর স্থগিত চাওয়া হয়েছে।

এর আগে ২ মে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি এবং যাবজ্জীবন দণ্ডিত এক আসামির আবেদন খারিজের রায় প্রকাশ করা হয়। আইন অনুসারে এখন রায়টি বিচারিক আদালত হয়ে কারাগারে যাবে। তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে পারবেন।

গত ৩ মে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জানিয়েছিলেন, এখন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে পারবেন। সেটা খারিজ করে হলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে।

ড. তাহেরের মেয়ে আইনজীবী সেগুফতা তাবাসুম আহমেদ বলেন, ‘রিভিউ খারিজের রায় হাতে পেয়েছি। এটা একটা আশার আলো। এখন আশা করছি অতি দ্রুত কার্যকর হবে।’

এর আগে গত ২ মার্চ প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে আট বিচারপতির আপিল বেঞ্চ রিভিউ খারিজ করে দেন।

ফলে একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, নিহত অধ্যাপক ড. তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলমকে ফাঁসির কাষ্ঠে যেতেই হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। তবে তার আগে তারা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করতে পারবেন। আর যথারীতি যাবজ্জীবন দণ্ডিতদের সাজাভোগ করতে হবে।

আদালতে আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান, সমরেন্দ্র নাথ গোস্বামী ও নিখিল কুমার সাহা। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ।

এর আগে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তিন আসামির আবেদনের ওপর শুনানি শেষে আদেশের জন্য ২ মার্চ দিন রাখেন আদালত।

২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাবির কোয়ার্টারের ম্যানহোলে পাওয়া যায় পদোন্নতি সংক্রান্ত বিষয়ের জের ধরে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার অধ্যাপক তাহেরের মরদেহ। ৩ ফেব্রুয়ারি নিহত অধ্যাপক তাহেরের ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ রাজশাহীর মতিহার থানায় অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

এ মামলায় ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ ছয়জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দিয়েছিল পুলিশ। এ হত্যা মামলার বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার আদালত চারজনকে ফাঁসির আদেশ ও দুজনকে খালাস দেন।

দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন—একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, নিহত অধ্যাপক ড. তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলম, নাজমুল আলম ও আব্দুস সালাম।

খালাসপ্রাপ্ত দুজন হলেন—রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী ও আজিমুদ্দিন মুন্সী।

২০০৮ সালে বিচারিক আদালতের রায়ের পর নিয়ম অনুযায়ী ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণ) হাইকোর্টে আসে। পাশাপাশি আসামিরা আপিল করেন। শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যা মামলায় দুই আসামির ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল এবং অন্য দুই আসামির দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন হাইকোর্ট। ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল রাখা দুই আসামি হলেন—একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও নিহত ড. তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম।

ফাঁসির দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া দুই আসামি হলেন—নাজমুল আলম ও আব্দুস সালাম।

এরপর আসামিরা আপিল বিভাগে আপিল করেন। পাশাপাশি যাবজ্জীবন দণ্ডিত দুই আসামির দণ্ড বাড়াতে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি শেষে গত বছরের ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের রায় বহাল রাখেন।

আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, আসামিদের স্বীকারোক্তিগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হত্যার এ ষড়যন্ত্রে মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিনই মুখ্য এবং সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। আমাদের এটা বলতে দ্বিধা নেই, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন শুধুমাত্র প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতি পেতেই ড. তাহেরকে এ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেন। তার ধারণা ছিল ড. তাহের বেঁচে থাকলে অধ্যাপক হিসেবে তার পদোন্নতি পাওয়া সম্ভব না।

আমাদের এও বলতে দ্বিধা নেই যে, আপিলকারী জাহাঙ্গীর আলম এবং আবেদনকারী আব্দুস সালাম ও নাজমুল আর্থিক সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার জন্য অধ্যাপক তাহেরকে হত্যার জন্য ড. মহিউদ্দিনের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন।

১৫ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। এরপর মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলম এবং যাবজ্জীবন দণ্ডিত সালাম রিভিউ আবেদন করেন। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রিভিউয়ের ওপর শুনানি শুরু হয়। এরপর শেষ হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি। আর রায় হয় ২ মার্চ।