ঢাকার সেটেলমেন্ট কোর্টের বিচারক জেলা জজ জুয়েল রানার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ পুনঃতদন্ত চেয়ে করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট।
সহযোগিতার প্রলোভন ও ধর্ষণ বিষয়ে পুনঃতদন্ত চেয়ে করা আবেদনের ওপর শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার (৮ জুন) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. বদরুজ্জামান ও বিচারপতি মাসুদ হোসেন দোলনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় দেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য। মামলার বাদীর পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট শেখ আতিয়ার রহমান।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, ধর্ষণের অভিযোগের পুনঃতদন্ত চেয়ে একটি আপিল ছিল। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০১৯ সালে আপিলটি শুনানির জন্য গ্রহণ করেন হাইকোর্ট। চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট বৃহস্পতিবার আপিলটি খারিজ করে রায় ঘোষণা করেছেন।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই ভুক্তভোগী ওই তরুণী ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণের অভিযোগ এনে মামলা করেন। মামলায় নারায়ণগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন বিচারক (জেলা জজ) জুয়েল রানা আসামি করা হয়।
ওই বছরের ২৪ জুলাই ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫-এ তরুণীর অভিযোগের বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমকে (সিএমএম) তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেন ট্রাইব্যুনাল।
তরুণী তার মামলার অভিযোগে বলেন, বিচারক জুয়েল রানা ঢাকার আদালতে অতিরিক্ত জেলা জজ পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় একটি পারিবারিক রিভিশন মামলা তার (বিচারক জুয়েল রানা) আদালতে বিচারাধীন ছিল।
বিচারক নিজে তরুণীকে ফোন করে তাকে সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলেন। বিচারক তাকে আদালতে অস্থায়ী স্টেনোগ্রাফার হিসেবে কাজে নিয়োগ দেন। সরকারি চাকরি নেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে তরুণীকে সাঁটলিপি শেখার জন্য ভর্তি হতে বলেন। এমন আচরণের মাধ্যমে তরুণীর বিশ্বাস অর্জন করেন বিচারক।
মামলার এজাহারে বলা হয়, বিচারক জুয়েল রানার অধীনে নিয়োগ পরীক্ষা হলেও তরুণীকে সরকারি চাকরি না দেওয়ায় তিনি অন্য কোম্পানিতে চাকরি নেন। তখন বিচারক জুয়েল রানা আবার তরুণীকে ফোন দিয়ে তার আদালতে আসতে বলেন।
তরুণী না আসতে চাইলে তার পারিবারিক মামলার আপিলে ক্ষতি করে দেবেন বলে হুমকি দেন। তখন তরুণী বাধ্য হয়ে আবার বিচারক জুয়েল রানার আদালতে আসেন এবং অস্থায়ীভাবে তার আদালতে কাজ করতে থাকেন।
মামলায় আরও বলেন, ২০১৫ সালের ৮ জুন বিচারক তরুণীকে তার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা বলে তার বাসায় নিয়ে যান। সেদিন বিচারকের বাসায় তার স্ত্রী-সন্তান কেউ ছিলেন না। একপর্যায়ে তাকে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের কথা কাউকে জানালে হত্যার হুমকি দেন বিচারক।
এজাহারে আরও বলা হয়, ওই তরুণী সেদিন বিচারকের বাসা থেকে বের হয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। পরদিন রমনা থানায় বিচারকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করতে যান তরুণী। তবে অতিরিক্ত জেলা জজ শুনে মামলা না নিয়ে পুলিশ তরুণীকে আদালতে মামলা করতে বলে। তরুণী সেদিন আদালতে তার ল্যাপটপ আনতে যান। তখন বিচারক তাকে অফিসে কাজ করতে বলেন। মুখ খুললে মেরে ফেলবেন বলে হুমকি দেন।
পরে তরুণী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে বিচারক তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তরুণীর সব চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করবেন বলে বিচারক তাকে আশ্বস্ত করেন। সুস্থ হলে তরুণীর সঙ্গে মীমাংসা করার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেন।
‘ছয় মাস অসুস্থ থাকার পরও সুস্থ না হলে বিচারকের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী- ২০১৫ সালের ৩ নভেম্বর তার খাসকামরায় দেখা করেন তরুণী। সেদিন বিচারককে বিয়ে করে ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করে তুলতে বলেন তরুণী। তা না হলে আইনের আশ্রয় নেবেন বলে বিচারককে জানান। বিষয়টি নিয়ে খাসকামরায় দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়।’
‘এরপর ৮ নভেম্বর রাতে র্যাব তরুণীকে আটক করে নিয়ে যায়। সেদিন র্যাব সদস্যরা ধর্ষণসংক্রান্ত চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে যায়। তরুণীর বিরুদ্ধে খিলক্ষেত থানায় ২০টি ইয়াবা রাখার অভিযোগে মামলা দেয় র্যাব। ২২ দিন জেল খাটার পর জামিন পান তিনি।’
এজাহারে বলা হয়, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর র্যাবের নিয়ে যাওয়া চিকিৎসকদের সনদের কপি তোলার সব চেষ্টা করেন তরুণী। কিন্তু ব্যর্থ হন। এর মধ্যে বিচারক তার বন্ধু সেলিম পাশাকে দিয়ে আপসের জন্য তরুণীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
পরে তরুণী ধর্ষণ ও ডিএনএ টেস্ট করার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদের কাছে যান। বিচারক এ খবর জানতে পেরে চিকিৎসক সোহেল মাহমুদকে ফোন দেন যাতে সনদ না দেওয়া হয়।
মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়, বিচারক সাময়িক বরখাস্ত থাকা অবস্থায় ইয়াবা মামলায় ঢাকার আদালতে হাজিরা দিতে গেলে ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই তরুণীকে তুলে রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বিচারকের করা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
পরের বছর ২২ ফেব্রুয়ারি তরুণী সেই মামলায় জামিন পান। ধর্ষণের কারণে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ও দুটি মিথ্যা মামলায় কারাগারে থাকায় মামলা করতে বিলম্ব হয়েছে বলে তরুণী আদালতকে জানান।
এ মামলার পর জেলা জজ জুয়েল রানাকে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। পরে এ অভিযোগের তদন্ত করে কোনো সত্যতা নেই মর্মে ঢাকার সিএমএম তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
২০১৮ সালের ২ অক্টোবর প্রতিবেদনটি ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। এরপর একই বছরের ২২ নভেম্বর তরুণীর অভিযোগ খারিজ করে দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে খালাস পাওয়ার পর অভিযুক্ত বিচারক ফের কাজে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকার একটি সেটেলমেন্ট আদালতে কর্মরত। এদিকে নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ২০১৯ সালে ওই তরুণী হাইকোর্টে একটি ফৌজদারি আপিল মামলা করেন।
এতে মামলায় অভিযোগের পুনঃতদন্ত অথবা অভিযোগ আমলে নেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়। বৃহস্পতিবার চূড়ান্ত শুনানি করে হাইকোর্ট মামলাটি খারিজ করে দেন।