চন্দন কান্তি নাথ: নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ অথবা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সনদের কার্যকারিতা প্রদানের লক্ষ্যে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু উক্ত আইনে অভিযোগ কে নেবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) বনাম বাংলাদেশ মামলায় মাননীয় আপিল বিভাগের রায়ের পর তা আরও বেড়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়। ওই বছরের ২৩ জুলাই মিন্টো রোডের গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে মারা যান রুবেল। এরপর তৎকালীন সরকার রুবেল হত্যা তদন্তের জন্য বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের সমন্বয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত শেষে কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করে।
এ সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) হাইকোর্টে রিট করে। রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল এ ব্যাপারে কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন হাইকোর্ট। এরপর ২০০৪ সালে আপিল বিভাগ সরকারের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন। তবে হাইকোর্টের ওই নির্দেশনাগুলো স্থগিত করেননি।
দীর্ঘদিন পরে ২০১৬ সালের ১৭ মে আপিল শুনানি শেষে ২৪ মে রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। এরপর একই বছরের ১০ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়। রায়ে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার (৫৪ ধারা) নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য ১০ দফা নীতিমালা করে দেন সুপ্রিম কোর্ট। একইসাথে ম্যাজিস্ট্রেটদের জন্য নয় দফা নীতিমালা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব পালনের বিষয়ে সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।আর ৮ ও ৯ নং দফায় বলা হয়-
৮) যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রিমান্ডে বা তাঁর হেফাজতে নেন, তখন তাঁর দায়িত্ব হচ্ছে নির্ধারিত সময় শেষে তাঁকে আদালতে হাজির করা। যদি পুলিশি প্রতিবেদন বা অন্য কোনোভাবে জানা যায় যে গ্রেপ্তার ব্যক্তি মারা গেছেন, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট মেডিকেল বোর্ডের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির (ভিকটিম) শারীরিক পরীক্ষার নির্দেশ দেবেন। যদি দেখা যায়, মৃত ব্যক্তির দাফন হয়ে গেছে, সে ক্ষেত্রে মরদেহ উঠিয়ে মেডিকেল পরীক্ষার নির্দেশ দেবেন। যদি মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদনে দেখা যায়, নির্যাতনের কারণে মৃত্যু হয়েছে, তবে ম্যাজিস্ট্রেট ২০১৩ সালের হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের ১৫ ধারা অনুযায়ী ওই কর্মকর্তা, সংশিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, যাঁর কাস্টডিতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, তাঁর বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নেবেন।
৯) যদি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপাদান বা তথ্য থাকে যে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩-এর ধারা ২-এ বর্ণিত সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি হেফাজতে নির্যাতন বা মৃত্যুর শিকার হয়েছেন, সে ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে নিকটস্থ চিকিৎসকের কাছে পাঠাবেন। আর মৃত্যুর ক্ষেত্রে আঘাত বা মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়ার জন্য মেডিকেল বোর্ডে পাঠাবেন। যদি মেডিকেল পরীক্ষায় দেখা যায় যে আটক ব্যক্তিকে নির্যাতন করা হয়েছে অথবা নির্যাতনের কারণে মৃত্যু হয়েছে, এ ক্ষেত্রে বিচারক সংশিষ্ট আইনের ৪ ও ৫ ধারায় মামলা দায়েরের জন্য অপেক্ষা না করে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ১৯০ (১)(সি) ধারা অনুযায়ী অপরাধ আমলে নেবেন।
এখানে লক্ষণীয় যে ৪ ও ৫ ধারায় মামলা দায়েরের জন্য অপেক্ষা না করে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ১৯০ (১)(সি) ধারায় অপরাধ আমলে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। আর সশ্লিষ্ট আইনের ৪ ধারায় বর্ণিত একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক দ্বারা অবিলম্বে ভিকটিমের দেহ পরীক্ষার আদেশের বিপরীতে আপিল বিভাগ ভিন্ন পদ্ধতি তথা মেডিকেল বোর্ড ঘটন কিংবা নিকটস্থ চিকিৎসক ইত্যাদির কথা বলেছেন।
তাহলে ৪ ও ৫ ধারায় কে অভিযোগ আমলে নেবে? এর সহজ উত্তর হচ্ছে দায়রা জজ আদালত নেবে। তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট এর কথা মহামান্য আপিল এনেছেন কেন? নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ আইনে কোথাও ম্যাজিস্ট্রেট কথাটি নেই। শুধুমাত্র দায়রা জজ আদালতের কথা আছে। সেটা ১৪ ধারায় বিচারিক এখতিয়ার বা ৭ ধারায় অভিযোগ গ্রহণের এখতিয়ার হোক দুক্ষেত্রেই দায়রা আদালতের কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু ৯ ধারায় একথাও বলা হয়েছে এই আইনে ভিন্নরূপ কিছু না থাকলে, কোন অপরাধের অভিযোগ দায়ের, তদন্ত, বিচার ও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে Code of Criminal Procedure 1898 (Act V of 1898) এর বিধানসমূহ প্রযোজ্য হবে। আর এই আইনের অধীন দণ্ডনীয় সকল অপরাধ বিচারার্থ গ্রহণীয় (Cognizable) হবে। আর এই রকম বিধান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনসহ সব আইনে থাকে। ফৌজদারি কার্যবিধিতে ১৯০ (১)(সি) ধারা ছাড়াও ১৯০ (১)(এ) ও ১৯০ (১)(বি) ধারা রয়েছে।
এই আইনে ধারা ৪ থেকে ৭ ধারায় ১৯০ (১)(এ) ও ১৯০ (১)(বি) ধারার বিধান রয়েছে কিন্তু ১৯০ (১)(সি) ধারার মত বিধান নাই। সে কারণে মহামান্য আপিল বিভাগ হয়ত উক্তরুপ নির্দেশনা দিয়েছেন অনুমান করা যায়।
কেননা নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ আইনে সংজ্ঞায় আদালতের নাম উল্লেখ না করলেও ‘এই আইনের এখতিয়ারধীন কোন আদালতের সামনে কোন ব্যক্তি যদি অভিযোগ করে যে শব্দাবলী’ উল্লেখ করে ৪ ধারায় বলা হয়েছে, ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ (Code of Criminal Procedure 1898, Act V of 1898) এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, তা সত্ত্বেও এই আইনের এখতিয়ারাধীন কোন আদালতের সামনে কোন ব্যক্তি যদি অভিযোগ করে যে, তাকে নির্যাতন করা হয়েছে, তা হলে উক্ত এখতিয়ারাধীন আদালত – তাৎক্ষণিকভাবে উক্ত ব্যক্তির জবানবন্দি গ্রহণ করবেন। তারপর একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক দ্বারা অবিলম্বে তাঁর দেহ পরীক্ষার আদেশ দিবেন। অভিযোগকারী মহিলা হলে রেজিস্টার্ড মহিলা চিকিৎসক দ্বারা পরীক্ষা করবার ব্যবস্থা করবেন। চিকিৎসক অভিযোগকারী ব্যক্তির দেহের জখম ও নির্যাতনের চিহ্ন এবং নির্যাতনের সম্ভাব্য সময় উল্লেখপূর্বক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উহার একটি রিপোর্ট তৈরী করিবেন। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক প্রস্তুতকৃত রিপোর্টের একটি কপি অভিযোগকারী অথবা তাহার মনোনীত ব্যক্তিকে এবং এই আইনের এখতিয়ারাধীন আদালতে পেশ করবেন। চিকিৎসক যদি এমন পরামর্শ দেন যে পরীক্ষাকৃত ব্যক্তির চিকিৎসা প্রয়োজন তা হলে এই আইনের এখতিয়ারাধীন আদালত ঐ ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করবার নির্দেশ প্রদান করবেন।
৫ ধারা মতে বিবৃতি লিপিবদ্ধ করবার পর এই আইনের এখতিয়ারধীন আদালত অনতিবিলম্বে বিবৃতির একটি কপি সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারের কাছে বা ক্ষেত্রমত, তদূর্ধ্ব কোন পুলিশ কর্মকর্তার কাছে প্রেরণ করবেন এবং একটি মামলা দায়েরের নির্দেশ প্রদান করবেন। পুলিশ সুপার উক্ত আদেশ প্রাপ্তির পর পরই ঘটনা তদন্ত করে চার্জ বা চার্জবিহীন রিপোর্ট পেশ করবেন। সংশ্লিষ্ট সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যদি মনে করেন যে পুলিশ দ্বারা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত সম্ভব নয় সেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তি যদি এই আইনের এখতিয়ারধীন আদালতে আবেদন করেন এবং আদালত যদি তাঁর আবেদনে এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদন যথার্থ সেক্ষেত্রে এই আইনের এখতিয়ারধীন আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ প্রদান করতে পারবেন। রিপোর্ট দাখিলের সময় তদন্ত কর্মকর্তা, ক্ষেত্রমত, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কর্মকর্তা বিবৃতি প্রদানকারী অভিযোগকারি ব্যক্তিকে তারিখসহ রিপোর্ট দাখিল সম্পর্কে অবহিত করবেন। নোটিশপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি নোটিশ গ্রহণের ৩০ দিনের মধ্যে নিজে ব্যক্তিগতভাবে অথবা আইনজীবী মারফত আদালতে আপত্তি জানাতে পারবেন। তখন আদালত সংঘটিত অপরাধের সংগে জড়িত ব্যক্তির পদমর্যাদার নিম্নে নয় এমন পদমর্যাদার কোন পুলিশ অফিসারকে মামলার তদন্ত অনুষ্ঠানের নির্দেশ প্রদান করবেন।
৬ ধারা মতে এই আইনে তৃতীয় পক্ষ দ্বারা অভিযোগও করা যায়। কোনো ব্যক্তিকে অন্য কোন ব্যক্তি নির্যাতন করেছে বা করছে এইরূপ কোন তথ্য তৃতীয় কোন ব্যক্তি এই আইনের এখতিয়ারধীন আদালতকে অবহিত করলে আদালত অভিযোগকারীর বিবৃতির ওপর নিজের মন্তব্য লিপিবদ্ধ করে উক্ত ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধান করবেন। যদি অভিযোগকারীর বক্তব্যে এই আইনের এখতিয়ারধীন কোন আদালত এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, ঘটনাস্থলে পরিদর্শন করা প্রয়োজন তা হলে আদালত উক্ত ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে পারবেন।৭ ধারামতে ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া সত্ত্বে তৃতীয় কোন ব্যক্তি এই আইনের এখতিয়ারধীন কোন আদালত তথা দায়রা জজ আদালতে অথবা পুলিশ সুপারের নিচে নয় এমন কোন পুলিশ কর্মকর্তার নিকট নির্যাতনের অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন।দায়রা জজ আদালতে অভিযোগ করা হলে উপরোক্ত উপায়ে জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করে পরবর্তি কাজ আগাবেন।
কিন্তু কোনো অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ সুপার অথবা তাঁর চেয়ে ঊধ্বর্তন পদমর্যাদার কোনো অফিসার তাৎক্ষণিক একটি মামলা দায়ের ও অভিযোগকারীর বক্তব্য রেকর্ড করবেন এবং মামলার নম্বরসহ এই অভিযোগের ব্যাপারে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে তা অভিযোগকারীকে অবহিত করবেন। অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণকারী পুলিশ সুপার অথবা তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অভিযোগ দায়েরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দায়রা জজ আদালতে একটি রিপোর্ট পেশ করবেন।আগেই বলা হয়েছে তৃতীয় কোন ব্যক্তি এই আইনের এখতিয়ারধীন আদালতকে অবহিত করলে আদালত অভিযোগকারীর বিবৃতির ওপর নিজের মন্তব্য লিপিবদ্ধ করে উক্ত ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধান করবেন।
তাছাড়াও ১১ ধারা মোতাবেক অভিযোগকারী কোনো ব্যক্তি এই আইনে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বিধানকল্পে দায়রা জজ আদালতে পিটিশন দায়ের করতে পারবে। রাষ্ট্র এবং যার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছে তাঁদেরকে উক্ত পিটিশনের পক্ষভুক্ত করা যাবে। পিটিশন গ্রহণ করে আদালত বিবাদীকে সাত দিনের নোটিশ জারি করবে এবং ১৪ দিনের মধ্যেই পিটিশনের ওপর একটি আদেশ প্রদান করবে।
আদালত প্রয়োজনবোধে ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্যূন সাত দিনের অন্তরীণ আদেশ দিতে পারবে এবং সময়ে সময়ে তা বৃদ্ধি করতে পারবে। আদালত এই আইনের অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধের তদন্ত কর্মকর্তাদের আদালতের আদেশ পালন নিশ্চিত করবার নির্দেশ দিতে পারবেন। আদালত নিরাপত্তা প্রার্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দিতে পারবেন এবং প্রয়োজনবোধে আদালত স্থানান্তর এবং বিবাদীর নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করাসহ নিরাপত্তার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।
কিন্তু অনেকের মতে দায়রা আদালতে মামলা দায়ের সম্পর্কিত এই আইনের ৭ ধারার শিরোনাম হলো- ‘অভিযোগের অপরাপর ধরণ’। সুতরাং, মামলা দায়েরের নিয়মিত ফোরামের বাইরে দায়রা আদালতকে ‘বিকল্প ফোরাম’ হিসেবে এই আইন ঘোষণা করেছে। এটা এই আইনের বিশেষত্ব। এই আইনে দায়রা আদালতে অভিযোগ দায়েরকে যেহেতু ‘অপরাপর ধরণ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, সুতরাং মামলা দায়েরের ‘নিয়মিত ধরন’ যে আছে, সেটা সহজেই বোধগম্য। সেই নিয়মিত ধরণ/ফোরাম কোনটি সেটি স্পষ্ট হয় এই আইনের ৯ ধারা পাঠ করলে।
যেখানে বলা হয়েছে, তদন্ত, অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হবে। আর ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হওয়া মানেই ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের এখতিয়ার বহাল থাকা। এই আইনে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের এখতিয়ার বারিত করা হয়নি কারণ ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের এখতিয়ার বারিত হলে এই আইন প্রণয়ন নিরর্থক হয়ে পড়বে। কারণ সংবিধান ও সিআরপিসি অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেই আসামির প্রডাকশন হয় এবং নির্যাতিত আসামির বক্তব্য প্রদানের সবচেয়ে উপযুক্ত ফোরাম ম্যাজিস্ট্রেট। এই আইনে ম্যাজিস্ট্রেটের এখতিয়ার যে অটুট আছে, সেটি মহামান্য আপিল বিভাগের ৬৯ ডিএলআর এডি ৬৩ মামলার রায়ের মাধ্যমে ‘অবিসংবাদিত’ হয়ে উঠেছে।
সেক্ষেত্রে বলা যায়,ম্যাজিস্ট্রেট কিভাবে উক্ত আইনের বাইরে আপিল বিভাগের রায়ে এখতিয়ার চর্চা করবে তা আগেই বলা হয়েছে। তবে উক্ত আইন অনুসারে নয়।ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে। আর দুজায়গায় অভিযোগ করার কথা বাংলাদেশের কোন আইনেই নাই। বিপরীতে বলা হয় – খোদ সিআরপিসিতে বেশ কিছু প্রতিকারের ক্ষেত্রে জুডিসিয়াল ও এক্সিকিউটিভ উভয় ম্যাজিস্ট্রেটকে এখতিয়ার দেয়া আছে। যেমন ১০০ ধারা। খোরপোষ আদায়ে পারিবারিক আদালতের পাশাপাশি পারিবারিক সহিংসতা আইনে ম্যাজিস্ট্রেটকেও এখতিয়ার দেয়া আছে। সিআরপিসির ৪৯৮ ধারায় বেইল দেয়ার এখতিয়ার দায়রা জজ ও হাইকোর্ট উভয়কে দেয়া আছে। কিন্তু ১০০ ধারা মামলা দায়ের সংক্রান্ত নয়। সার্চ সংক্রান্ত। আর পারিবারিক আদালত ও পারিবারিক সহিংসতা আইন ভিন্ন আইনে পরিচালিত হয়।একটা ফৌজদারি আইন এবং অন্যটি পারিবারিক আদালতের বিশেষ আইন।আবার জামিন সংক্রান্তে যা উল্লেখ করা হয় তাও অভিযোগ দায়ের সংক্রান্ত নয়।
অনেকের প্রশ্ন হলো, এই আইনে ৭ ধারাকে অভিযোগের অপরাপর ধরণ হিসেবে কেনো বলা হলো? প্রকৃতপক্ষে দায়রা আদালত এই আইনের অভিযোগগ্রহণকারী আদালত নয়। দায়রা জজ আদালতে ক্ষতিগ্রস্ত নয় এমন তৃতীয় পক্ষ ৭ ধারায় অভিযোগ করতে পারবেন। কিন্তু এই প্রশ্নের বিপরীতে পূনরায় উল্লেখ করা যায় যে, উক্ত ধারায় পুলিশ অভিযোগ পেয়ে কি করবেন থাকলেও দায়রা জজ আদালত কি করবেন তা নাই। তাহলে নিশ্চিতভাবে এই আইনের এখতিয়ারধীন দায়রা আদালত ৪ ও ৫ ধারা অনুসারে আগাবেন। আবার এসপি বা তদুর্ধ্ব কর্মকর্তা দায়রা জজ আদালতে অভিযোগ দায়েরের ২৪ ঘন্টার মধ্যে একটি রিপোর্ট পেশ করবেন।
যেমন রেজিস্ট্রার্ড ডাক্তার ৪ ধারায় ২৪ ঘন্টার মধ্যে এই আইনের এখতিয়ারধীন আদালতে রিপোর্ট পেশ করেন। মূলত ৭ ধারাটি ৫ ও ৬ ধারার অতিরিক্ত সংযোজন এবং অভিযোগের সর্বশেষ ধরণ। ৭ ধারায় সেকারণেই ছাড়াও কথাটি আছে। ৭ ধারটি তাই এখানে উল্লেখ করা হল: ৭। (১) ধারা ৫ ও ৬ এ বর্ণিত প্রক্রিয়া ছাড়াও কোন ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া সত্ত্বে তৃতীয় কোন ব্যক্তি দায়রা জজ আদালতে অথবা পুলিশ সুপারের নিচে নয় এমন কোন পুলিশ কর্মকর্তার নিকট নির্যাতনের অভিযোগ দাখিল করিতে পারিবে।
(২) উপ-ধারা (১) এ বর্ণিত এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ সুপার অথবা তাহার চেয়ে ঊধ্বর্তন পদমর্যাদার কোনো অফিসার তাৎক্ষণিক একটি মামলা দায়ের ও অভিযোগকারীর বক্তব্য রেকর্ড করিবেন এবং মামলার নম্বরসহ এই অভিযোগের ব্যাপারে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইতে পারে উহা অভিযোগকারীকে অবহিত করিবেন।
(৩) উপরে বর্ণিত উপ-ধারা (২) মোতাবেক অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণকারী পুলিশ সুপার অথবা তাহার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অভিযোগ দায়েরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দায়রা জজ আদালতে একটি রিপোর্ট পেশ করিবেন।
আবার উপমহাদেশে সকল আইনে স্বীকৃত যে দুই আদালতে অভিযোগ করা যায় না। এর বিপরীতে যুক্তি দেয়া হয় বস্তুত হেফাজতে নির্যাতন আইনটি বিশেষ ধরনের আইন। এখানে ৭ ধারায় ‘অপরাপর অভিযোগের ধরণের ফোরামের’ দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এখানে দায়রা জজের পাশাপাশি পুলিশ সুপারকেও এখতিয়ার দেয়া আছে। আর সহকারি জজ আদালতের মামলা যুগ্ম জেলা জজ আদালতে করা যায়। কিন্তু উক্ত আইনে পুলিশ সুপারকে অভিযোগ গ্রহণ করার ক্ষমতা দেয়াটা নারী ও শিশু আইনে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত তথা একজন জেলা জজকে ও থানায় অফিসার ইনচার্জকে অভিযোগ গ্রহণের ক্ষমতা দেয়ার মত। আর সিপিসির ১৫ ধারায় আছে, প্রত্যেকটি মামলা উহা বিচার করার যোগ্যতাসম্পন্ন সর্বনিম্ন পর্যায়ের আদালতে দায়ের করতে হবে। তাই দুই আদালতে অভিযোগ করার সুযোগ নাই। কেননা ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ২০১ ধারায় আছে,যদি এমন কোন ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট লিখিত অভিযোগ করা হয় যিনি ঘটনাটি আমলে নিতে উপযুক্ত নহেন তাহলে তিনি উহা যথাযথ আদালতে দাখিল করার জন্য সেইমৰ্মে পৃষ্ঠাঙ্কন করে অভিযোগটি ফেরৎ দিবেন। অভিযোগটি যদি লিখিতভাবে করা না হয়, তাহলে উক্ত ম্যাজিষ্ট্রেট ফরিয়াদীকে উপযুক্ত আদালত প্রেরণ করবেন।
তাই একথা পুনরায় বলা যায়, নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর অধীনে অভিযোগ দায়রা জজ আদালত নিবে। ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নয়।আর ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আপাতত ১৯০(১)(সি) মোতাবেক আগাতে পারে। কিন্তু অভিযোগ নিতে পারলে তিনি মামলা আমলে নিতে পারবেন কি? আর এ ক্ষেত্রে ও বিতর্ক থাকলে মাননীয় আপিল বিভাগে উক্ত রায়ের রিভিউ আবেদনে তা নিষ্পত্তি হতে পারে। আর আদালত আইন তৈরি করতে পারেনা যুক্তিতে ইতিমধ্যেই ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা ও রিমান্ড সংক্রান্ত ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনার বিষয়ে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। যা শুনানির অপেক্ষায় আছে এবং সেখানেই আশা করি সকল ধোঁয়াশা দূর হবে।
লেখক: বিচারক, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ), বরিশাল।