মো: আল-আমিন : প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও বিকাশের সাথে সাথে আমাদের জীবনে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটারের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলছে৷ এসব ডিভাইসের ভালো ও মন্দ দুটো দিক রয়েছে৷ আমাদের বর্তমান কিশোর প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যারা আছেন তারা এসব ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমে ভালো দিকের চেয়ে খারাপ জিনিস দ্বারাই অধিকতর প্রভাবিত হচ্ছে৷ এই প্রভাব এতটাই ক্রমবর্ধমান যে কিশোর ছেলেমেয়েরা গ্যাং-কালচারে লিপ্ত হচ্ছে এবং এর সাথে নানা ধরনের অপরাধের সাথে সংযুক্ত হচ্ছে৷ শুধু তাই নয় হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ সহ সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চলছে কিশোর গ্যাং৷ বিভিন্ন ধরনের ভয়াবহ মাদকের সাথে তারা জড়িয়ে পড়েছে৷ তাদের আচরণগত অবস্থা, পোশাক পরিচ্ছেদ সম্পূর্ণ অশালীন, অসামাজিক ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ যেটি কোন ভদ্র আচরণ এর সাথে সম্পূর্ণ বিপরীত৷
কিশোর গ্যাং বৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে বিদেশী সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ, পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান ও একজন কিশোর এর জীবনযাত্রার মান। বিভিন্ন ধরনের ভিডিও গেইম আছে যেগুলো কিশোরদের মনে গ্যাং কালচার তৈরি করার জন্য প্রভাব ফেলছে৷ এই ধরনের গেইমে সাধারণত মানুষ কে খুন করা, ড্রাগস নেওয়া, বিভিন্ন ধরনের ভারী অস্ত্র চালানো, সামাজিক আশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, এলাকা ভিত্তিক গ্যাং কীভাবে তৈরি করতে হবে সে সকল বিষয় সম্পর্কে কিশোরদের কচি মনে এক ধরনের ভয়ানক ভাইরাস ঢুকিয়ে দিচ্ছে৷ যার ফলশ্রুতিতে কিশোররা গেইম এর জগত ছেড়ে বাস্তবিক জীবনেও এসকল চর্চা করছে এবং নিজের এলাকাতে গ্যাং তৈরি করে চলছে এর সাথে নানা ধরনের অপরাধের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে৷ যেখানে মাদকের মত অপরাধের সাথেও জড়িয়ে পড়ছে শিশুরা৷
যদিও প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের রক্তের মাঝে মিশে গেছে, তারপরেও আমরা নিজেরা সচেতন হলে আমাদের শিশু, কিশোরদেরকে এই ধরনের গ্যাং কালচার থেকে বের করে একটি সুন্দর জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবো৷ আমাদের কিছু সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যার মাধ্যমে গ্যাং কালচার থেকে কিশোরদেরকে হেফাজত করা যেতে পারে৷
১/ পারিবারিক কঠোর শাসন ও স্নেহ দিয়ে কিশোরদের যথাযথ তদারকি করতে হবে। তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করে কি করছে, তারা কি শিখছে, কাদের সাথে মেলামেশা করছে এসব বিষয় গুলো বিশেষ নজর দিতে হবে৷
২/সামাজিক মাধ্যমে তাদের অবস্থান কতটুকু,অনলাইন গেমিং প্লাটফর্মে তারা গ্যাং কালচার শিখছে কি না বা গ্যাং কালচারের সাথে জড়িয়ে পড়েছে কি না তা তদারকি করতে হবে৷ এক্ষেত্রে বাবা, মা, বড় ভাই, বোন সহ পরিবারের যে কোন সদস্য ভূমিকা রাখতে পারেন৷
৩/ছিন্নমূল শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে যত্ন নিতে হবে৷ এর জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, এন জি ও বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন৷
৪/ধর্মীয় শিক্ষা হচ্ছে মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা৷ কিশোরদের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে৷
৫/ অবসর সময়ে পরিবারের সকলে মিলে গল্প করা, বেড়াতে যাওয়া এবং ইতিবাচক সংস্কৃতি কি এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা যেতে পারে৷
৬/শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন৷ শ্রেণিতে আলোচনা করতে পারেন কিশোর গ্যাং এর ক্ষতিকর প্রভাব ও সামাজিক অবক্ষয় সম্পর্কে৷
৭/ইতিবাচক সংস্কৃতি গড়ে তোলার মনোভাব এবং এর সাথে সাথে ভালো সাহিত্যের বই শিশু -কিশোরদের অনুপ্রাণিত করতে পারবে৷
৮/শিশু আইনে গ্যাং-কালচার এর বিধান ও এর শাস্তি যুক্ত করে আইন প্রয়োগ করতে হবে৷ এছাড়া ছিন্নমূল শিশু-কিশোর ও যারা গ্যাং কালচার এর সাথে জড়িত তাদের কে সরকার, এন জি ও এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে খুজে বের করে আলাদা করতে হবে এবং তাদের কে যথাযথ তদারকির মধ্যে রাখতে হবে৷
৯/বিভিন্ন খেলাধুলা ও সমাজ কল্যাণমূলক কাজে কিশোরদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে৷
১০/কিশোরদের আচরণগত পরিবর্তন দেখলেই তাদের কে স্নেহ দিয়ে, খোলামেলা আলোচনা করতে হবে।
পরিশেষে, অপরাধ কে পরিপূর্ণ ভাবে নির্মূল করা কখনোই সম্ভব হয় না৷ আমরা আমাদের নিজেদের জায়গা থেকে যথাযথ ভাবে সচেতন হয়ে, পরিবারের সন্তানদের কে তাদের আচরণ এর পরিবর্তন করার চেষ্টা করলে আশা করা যায় গ্যাং কালচার অনেকাংশেই কমবে৷ মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের কিশোরদেরকে হেফাজতে রাখুন৷
লেখক: মো: আল-আমিন; আইনজীবী, জেলা ও দায়রা আদালত, ঢাকা৷