খুলনা আদালত আঙ্গিনায় ঘাটে ঘাটে চলছে বিরামহীনভাবে বকশিশ বাণিজ্য
মহানগর দায়রা জজ আদলত, খুলনা

খুলনা আদালত আঙ্গিনায় ঘাটে ঘাটে চলছে বিরামহীনভাবে বকশিশ বাণিজ্য

অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা: আমি আমার কথা দিয়ে শুরু করি।যাই হোক, আমি গত ২০০২ সালে খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতিতে যোগদান করি। তখন থেকেই একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, যে আদালতেই পেশাগত দায়িত্ব পালন করার জন্য যেতে হয়েছে, সেখানে অত্র আদালতের অধীনস্থ পেশকর, এমএলএসএস ও অন্যান্য যারা সংশ্লিষ্ট আদালতের কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে, তারা প্রত্যেকেই যে কোনো ধরনের দরখাস্ত জমা দিতে গেলে বলে খরচ -খরচা দেন।

আমার প্রশ্ন, তারা কি সরকারি বেতন ভাতা উত্তোলন করেন না? তাদেরকে স্ব-স্ব কাজের জন্য সরকার নিয়োগ দিয়েছেন এবং তারা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে এটাই তো স্বাভাবিক।

অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে বলতে হচ্ছে যে, এই সমস্ত পেশকর, এমএলএসএস ও অন্যান্যরা তাদের র‍্যাঙ্ক অব স্ট্যাটাস বেমালুম ভুলে গিয়ে অর্থের লোভে আইনজীবীদের কাছে পর্যন্ত বকশিশ দাবি করে। আর বিচার প্রার্থীদের এরা যেভাবে বিভিন্ন কায়দায় আর্থিক নির্যাতন করে, যেটা বলে শেষ করা যাবে না।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, প্রসেস সার্ভেয়ার যখন প্রসেস জারি করতে যায়, তখন মামলার বাদির সাথে মোবাইল ফোনে বিভিন্ন ধরনের কথা বলে নোটিশ জারি করে দেবে মর্মে বকশিশ দাবি করে। আর সে দাবিটা করে পার্টির অবস্থা বুঝে। অর্থাৎ সেটা ১/২ থেকে ৫/১০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করে। এমনকি বিবাদী/আসামির কাছে যেও দুর্নীতির চিত্রটি ঠিক একই রকমের।

প্রতিটি আদালতের প্রসেস সার্ভেয়ারের দুর্নীতির মাত্রা সীমাহীন। যেটা বর্ণনাতীত। এমন ভয়াবহ দুর্নীতি ও অনিয়ম আর হতে দেওয়া যায় না। প্রতিটি আদালতে একই চিত্র বিদ্যমান। শুধু কম আর বেশি।

খুলনায় মোট ৪৮টি আদালত রয়েছে। আমি কোনো আদালতকে বাদ দিয়ে বলছি না। সব ক্ষেত্রে একই অবস্থা। একটি মামলায় যেকোনো ধরনের দরখাস্ত, জামিননামা, রিকল এমনকি যেকোনো সাক্ষী তার জবানবন্দি প্রদান করার পর জবানবন্দিতে সই করতে গেলে পিয়ন বলে খরচ, খরচা দেন। এমনকি জিআরওদেরও বিভিন্ন খাতে টাকা দিতে বাধ্য হতে হয়। উপায়হীন গন্তব্যে চলছে। এর পরিত্রাণ কোথায়?

কোন নকল নিতে গেলে সেখানে ভোগান্তির শেষ নাই। কোন মামলার নকল নিতে গেলে কয়েক জায়গায় টাকা দিতে হয়। অন্যথায় দিনের পর দিন নকলের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এমনকি নাম সংশোধনের এ্যাফিডেভিট করতে গেলেও বকশিশ ছাড়া কথা নাই।

এহেন প্রেক্ষাপটে বিচার প্রার্থীরা এমন দুর্নীতিবাজদের চাহিদা মেটাতে না পারার কারণে আইনের আশ্রয় নেয়া থেকে দূরে সরে যাবে। আল্টিমেটলি বিচার ব্যবস্থার প্রতি আসবে চরম অনিহা। কারণ শত দুর্নীতিবাজদের ভিড়ে বিচার প্রার্থীদের মনে আসবে আশঙ্কা। কাজেই বিচারপ্রার্থীরা দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতির কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে নতুবা নিজেকে গুটিয়ে নিবে। কারণ বিচারপ্রার্থীরা এদের কাছে অসহায়।

আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে বহু সেরেস্তা ও এজলাসে সরাসরি এমন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি। সত্যি কথা বলতে কি দশের লাঠি একের বোঝা। কারণ অসৎ পথের পাল্লা ভারি। সৎ পথে ভীড় কম।

আদালত আঙ্গিনায় এ সমস্ত সরকারি কর্মচারীরা দন্ডবিধির ১৬১ ধারাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অকপটে নির্দ্বিধায়, নির্লজ্জের মত অনিয়ম ও দুর্নীতি করে যাচ্ছে। মানছে না “সরকারি চাকরী (আচরণ) বিধিমালা আইন” সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বকশিশের বিরুদ্ধে নির্দেশনা দিয়েছেন।

আমি একা হলেও মানবতার স্বার্থে লিখে যাব। তবে যে কোন ভাবেই হোক কোর্ট আঙ্গিনায় এমন প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন আসুক এটাই কাম্য। সবশেষে বলবো ২১ বছর আগে যে দুর্নীতির প্রেক্ষাপট আমি দেখেছিলাম, এখনকার প্রেক্ষাপট তার থেকে আরও মারত্মক ও ভয়াবহ। শেষান্তে জাতীয় স্বার্থে, জনস্বার্থে ও বিচার প্রার্থীদের স্বার্থে কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

লেখক: অ্যাসিস্ট্যান্ট পাবলিক প্রসিকিউটর; জজ কোর্ট, খুলনা।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম বিষয়টি অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হয়নি।