২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা: মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায়

১৯ বছর আগে এই দিনে ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ১৪ বছর পর নৃশংস সেই হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় বিচারিক আদালতে রায় হয়। এখন মামলাটি হাইকোর্টে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। এরই মধ্যে আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) ও আপিলের ওপর হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়েছে।

বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এ-সংক্রান্ত মামলা দুটির (হত্যা ও বিস্ফোরক) ডেথ রেফারেন্সসহ আসামিদের আপিল আংশিক শ্রুত হিসেবে রয়েছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ডেথ রেফারেন্স শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক (এজাহার, অভিযোগপত্র ও বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলার বৃত্তান্ত) তৈরি করা হয়। পেপারবুক পড়া প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। পেপারবুক থেকে প্রায় ৩০ হাজার পাতা পড়া শেষ হয়েছে। আর চার-পাঁচ শ পাতা বাকি আছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি অসুস্থ থাকার কারণে কয়েক দিন ধরে দ্বৈত বেঞ্চটি বসছেন না। তিনি সুস্থ হয়ে বেঞ্চে বসলে শুনানি আবার শুরু হবে। আর ১২ থেকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে শুনানি শেষ হয়ে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

কোনো মামলায় আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে, যা ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) মামলা হিসেবে পরিচিত। এ অনুসারে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য বিচারিক আদালতের রায় ও নথিপত্র হাইকোর্টে পাঠানো হয়। ডেথ রেফারেন্স, আসামিদের জেল আপিল, আপিল ও বিবিধ আবেদনের ওপর সাধারণত একসঙ্গে শুনানি হয়ে থাকে। শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক প্রস্তুত করতে হয়।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে দলের নেতা-কর্মীসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ কয়েক শ নেতা-কর্মী।

ভয়ংকর সেই গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনার তদন্তকে ভিন্ন খাতে নিতে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার নানা তৎপরতা চালায়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এ-সংক্রান্ত মামলা দুটির (হত্যা ও বিস্ফোরক) নতুন করে তদন্ত শুরু করে, বেরিয়ে আসে নতুন তথ্য।

তদন্ত শেষে ২০০৮ সালে হরকাতুল জিহাদের (হুজি) অন্যতম শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। তাতে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ওই হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা।

পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মামলার অধিকতর তদন্ত হয়। এরপর তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। মোট আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২।

২০১৮ সালে মামলার রায় দেন বিচারিক আদালত। একই বছর রায়সহ মামলা দুটির নথিপত্র হাইকোর্টে আসে, যা সংশ্লিষ্ট শাখায় ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। এরপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলা দুটির পেপারবুক ছাপানো হয়। এর মধ্যে কারাগারে থাকা ও জামিনে থাকা দণ্ডিত আসামিরা দুই মামলায় জেল আপিল ও নিয়মিত আপিল করেন।

২০২২ সালের অক্টোবরে প্রধান বিচারপতি ডেথ রেফারেন্স মামলা দুটি শুনানির জন্য হাইকোর্টের ওই বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন। রাষ্ট্রপক্ষ পেপারবুক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর শুনানি শুরু করে।

হত্যা মামলায় পেপারবুক থেকে ২২৫ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২৪ জনের সাক্ষ্য রাষ্ট্রপক্ষ উপস্থাপন করেছে বলে জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ। তিনি বলেন, একজন সাক্ষী উপস্থাপন বাদ রয়েছে। এরপর পেপারবুক থেকে বিচারিক আদালতের রায় উপস্থাপন করা হবে।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একজনসহ দণ্ডিত তিন আসামির আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের পেপারবুক উপস্থাপন এখনো শেষ হয়নি। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি অসুস্থ থাকায় এখন শুনানি চলছে না। রাষ্ট্রপক্ষের পেপারবুক উপস্থাপন শেষে আসামিপক্ষ যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শুরু করবে।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা

বিচারিক আদালত ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। তাঁরা হলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, জঙ্গিনেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ, মাওলানা আবু সাঈদ, মুফতি মঈনউদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, হাফেজ আবু তাহের, মো. ইউসুফ বাট ওরফে মাজেদ বাট, আবদুল মালেক, মফিজুর রহমান ওরফে মহিবুল্লাহ, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হোসাইন আহমেদ তামিম, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ও মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন। তাঁদের মধ্যে ১৪ জন হুজির নেতা-কর্মী। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম ও হুজির সাবেক আমির শেখ আবদুস সালাম ২০২১ সালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।

যাবজ্জীবন দণ্ডিত যাঁরা

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপির নেতা হারিছ চৌধুরী, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন, আরিফুল ইসলাম, জঙ্গিনেতা মুফতি আবদুর রউফ, হাফেজ ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবদুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মুরসালিন, মুত্তাকিন, জাহাঙ্গীর বদর, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, আবু বকর সিদ্দিক ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মো. ইকবাল, রাতুল আহমেদ, মাওলানা লিটন, মো. খলিল ও শাহাদত উল্লাহ ওরফে জুয়েল।

মামলার নথিপত্র অনুযায়ী, তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৬ জন পলাতক। তবে হারিছ চৌধুরী ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা গেছেন বলে গত বছরের জানুয়ারিতে তাঁর মেয়ে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সামিরা চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানান। তবে সরকার এখন পর্যন্ত এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেনি।

বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত যাঁরা

বিচারিক আদালত বিভিন্ন মেয়াদে ১১ জনকে দণ্ড দিয়েছেন। তাঁরা হলেন মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমীন, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার, লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ওরফে ডিউক, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী; সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান, ডিএমপির সাবেক ডিসি (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সিআইডির সাবেক পুলিশ সুপার রুহুল আমীন এবং সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ ও মুন্সী আতিকুর রহমান।

অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর তিনজনের

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় মোট আসামি ছিলেন ৫২ জন। তাঁদের মধ্যে হুজির নেতা মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলমের ফাঁসি কার্যকর হয় ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায়। আরেক আসামি জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়। বাকি ৪৯ জনের বিরুদ্ধে বিচারিক আদালত রায় দেন। তাঁদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজনের সাজা ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। এখন ভুক্তভোগীদের দৃষ্টি মূলত ডেথ রেফারেন্সের নিষ্পত্তির দিকে।