সিভিল কোর্টে মামলা চলমান থাকলে এডিএম কোর্টে মামলা চলে কিনা?
অ্যাডভোকেট সাব্বির এ মুকীম

সংক্ষেপে সহজে ভূমি অপরাধ আইন ২০২৩

সাব্বির এ মুকীম: গত ১৮/০৯/২০২৩ ইং তারিখে ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২৩ গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। বক্ষ্যমান লেখায় সংক্ষেপে আইনটিকে ভূমি অপরাধ আইন লেখা হয়েছে।

ভূমি অপরাধ সমূহ

ভূমি অপরাধ আইনে মোট ১১ (এগারো) রকম ভূমি অপরাধ এর কথা বলা হয়েছে। যথা:-

(১) ভূমি প্রতারণা অপরাধ

(২) ভূমি জালিয়াতি অপরাধ

(৩) অবৈধ দখল জনিত অপরাধ

(৪) বিক্রিকৃত ভূমির দখল হস্তান্তর না করার অপরাধ

(৫) ভূমির সীমানা বা ভূমির ক্ষতিসাধন করার অপরাধ

(৬) সর্বসাধারণ ব্যবহার্য ভূমি দখল সংক্রান্ত অপরাধ

(৭) সর্বসাধারণ ব্যবহার্য ভূমি পরিবর্তন সংক্রান্ত অপরাধ

(৮) বিনা অনুমতিতে ভরাট/ক্ষণন করার অপরাধ

(৯) পুনঃরুদ্ধারকৃত দখল বেদখলের অপরাধ

(১১) একই অপরাধ পুনরায় করার অপরাধ

(১২) অপরাধীকে সহায়তা ও প্ররোচনা দেয়ার অপরাধ

নির্ধারিত সাজা

এই আইনে উপরে উল্লেখিত ১ম দুই ধরনের অপরাধের সাজা অনধিক ৭ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড। পরের ৮ ধরনের অপরাধের সাজা অনধিক ২ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড। অপরাধীকে সহায়তা ও প্ররোচনা দেয়ার অপরাধের সাজা, মূল অপরাধের সমান রাখা হয়েছে।

ভূমি অপরাধের বিচারে আমলি ও বিচারিক আদালত

ভূমি অপরাধ আইন ২০২৩ এর আলোকে উপরের ১১ ধরণের অপরাধের অভিযোগ আমলে নেয়ার এবং বিচার করার ক্ষমতা ১ম শ্রেণীর বিচারিক হাকিম কে প্রদান করা হয়েছে। বিশেষ করে ভূমি প্রতারণা, ভূমি জালিয়াতি উদ্ধারকৃত ভূমি দখল ও একই অপরাধ পূর্ণ সংগঠনে অপরাধ এর অভিযোগ আমলে নেয়ার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র বিচারিক হাকিম দ্বারা আমলযোগ্য রাখা হয়েছে। এই ৪(চার) অপরাধ ব্যতীত বাকি ৭ শ্রেণীর অপরাধ ভ্রাম্যমান আদালতে আমলে নিতে ও বিচার করতে- বিজ্ঞ নির্বাহী হাকিমদেরও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এই ৭ শ্রেণীর অপরাধ নির্বাহী হাকিম বিচার করতে পারবেন, বিচারিক হাকিমও বিচার করতে পারবেন।

 জামিনযোগ্যতা

ভূমি অপরাধ আইন ২০২৩ এ ভূমি প্রতারণা ও ভূমির জালিয়াতির অপরাধকে জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। বাকি অপরাধগুলো জামিনযোগ্য। এছাড়াও সকল অপরাধ আমলযোগ্য এবং আপষযোগ্য।

 বিধিমালা

এই আইনে একটি বিধিমালা অদূর ভবিষ্যতে প্রণয়ন হবে। তার আগ পর্যন্ত ভূমি অপরাধসমূহের মধ্যে কেবলমাত্র সর্বসাধারণের ব্যবহার্য ভূমি সংক্রান্ত অপরাধ বিচারে সরকারি ভূমি দখল পুনরুদ্ধার অধ্যাদেশ ১৯৬০ প্রয়োগ করতে বলা হয়েছে ।

কিছু ভূমি অপরাধ এর বিস্তারিত

(১) ভূমি প্রতারণা অপরাধ কি কি ?

৪টি স্তরে ভূমি প্রতারণা অপরাধ হতে পারে। যথা-

(ক) ভূমি হস্তান্তর স্তরে

(খ) ভূমি জরিপের স্তরে

(গ) রেকর্ড হালনাগাদের স্তরে তথা নামজারি গয়রহঃ স্তরে

(ঘ) ভূমি ব্যবস্থাপনার স্তরে

এই স্তরে স্তরে নীচের কাজগুলো ভূমি প্রতারণার অপরাধ বলে গণ্য হবে,:-

  • অন্যের জায়গা নিজের বলে প্রচার করা,
  • জরুরী তথ্য গোপন করে ভূমি বিক্রি দান গয়রহঃ উপায়ে হস্তান্তর করা,
  • নিজের মালিকানার অতিরিক্ত জায়গা বিক্রি গয়রহঃ হস্তান্তর করা
  • ভুয়া ব্যক্তি কে মালিক সাজিয়ে বিক্রি গয়রহঃ হস্তান্তর করা,
  • মিথ্যা তথ্য দিয়ে দলিল তৈরি করা
  • কর্তৃপক্ষের নিকট মিথ্যা তথ্য দেওয়া

ভূমি জালিয়াতির অপরাধ কি কি ?

উপরে উল্লেখিত চারটি স্তরে নিচের কাজসমূহ ভূমি জালিয়াতি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে; যথা:-

  • ভূয়া দলিল সৃজণ করা,
  • দলিল সম্পাদনের পর তা বেআইনিভাবে পরিবর্তন করা
  • প্রতারণা, জোর জব্বরে গয়রহঃ করে কাউকে দলিল সম্পাদন করতে বাধ্য করা

অবৈধ দখল অপরাধ কি কি?

নিচের কাজসমূহ ভূমি অবৈধ দখল অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে; যথা:-

  • আইনসম্মত উপায়ে মালিক না হয়ে কোনো ভূমি দখলে রাখা,
  • আইন সম্মত উপায়ে মালিক কে ভূমি দখল হতে উচ্ছেদ করা,
  • আইন সম্মত উপায়ে মালিক কে ভূমি দখলে বাঁধা প্রদান করা,

অবৈধ দখল এর প্রতিকার

এই আইনে বৈধ কোনো বেদখল হওয়া ব্যক্তি তার বৈধ দখল পুনরুদ্ধার করতে নিচের পদক্ষেপ এর সুযোগ নিতে পারবেন।

  • এলাকার ক্ষমতাপ্রাপ্ত বিজ্ঞ নির্বাহী হাকিম বরাবর দরখাস্ত করতে পারবেন,
  • উক্ত দরখাস্ত প্রাপ্তির পর বিজ্ঞ নির্বাহী হাকিম অবৈধ দখল সম্পর্কে সরজমিন তদন্ত করবেন,
  • বিবদমান উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনবেন
  • অবৈধ দখল, বেদখল সম্পর্কে বিজ্ঞ নির্বাহী হাকিম নিশ্চিৎ হবেন
  • ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো পক্ষ অনুপস্থিত থাকলে বিজ্ঞ নির্বাহী হাকিম উপযুক্ত আদেশ দিতে পারবেন
  • বিজ্ঞ নির্বাহী হাকিম উদ্ধারের আবেদনের তিন মাসের মধ্যে উদ্ধার কাজ শেষ করবেন,
  • যদি দেওয়ানী আদালতের উদ্ধার সংক্রান্ত কোনো মামলা চলমান থাকে তবে এই আইনের আশ্রয়ে উদ্ধার করা যাবেনা,
  • তবে চলমান দেওয়ানী মামলায় যে কোনো পক্ষই বিজ্ঞ দেওয়ানী আদালতে এই আইনের অধীনে ব্যবস্থা নিতে বিজ্ঞ নির্বাহী হাকিম এর প্রতি নির্দেশ প্রার্থণা করতে পারবেন,
  • এ আইনের চলমান ফৌজদারি মামলায় বিচারিক হাকিম উপযুক্ত মনে করলে দখল উদ্ধারে বা ক্ষতিপূরণ আদায়ের নিমিত্তে ব্যবস্থা নিতে বিজ্ঞ নির্বাহী হাকিম এর প্রতি নির্দেশ দিতে পারবেন,

এই আইনের আরও কিছু বৈশিষ্ট্য

  • এই আইনে দলিল বলতে কেবল বিভিন্ন প্রকার দলিলই নয় বরং দলিলের রশিদ, নকশা, খতিয়ান, ডিসিআর, খাজনার দাখিলা, বরাদ্দপত্র, ছাড়পত্র অনাপত্তিপত্র, এফিডেভিট গয়রহঃ কে দলিল এর মর্যাদা দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে,
  • এই আইনে ব্যাক্তির পাশাপাশি সংস্থা ও ভূমি সংক্রান্ত প্রতিকার চাইতে পারবে,
  • এই আইনে সার্ভে আইন ১৮৭৫, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন ১৮৮২, অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৪৯, প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০, দেওয়ানি কার্যবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি গয়রহঃ আইনগুলোর বিধান গ্রহন করা হয়েছে,
  • এই অনান্য আইনের অতিরিক্ত হিসেবে গণ্য হবে, বিরোধী হবে না,
  • রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯০৮ মোতাবেক হওয়ার পাশাপাশি এই আইন মোতাবেক জমি বিক্রি গয়রহঃ হস্তান্তর করতে হলে হস্তান্তরকারীর নিজ নামে খতিয়ান ও হালনাগাদ খাজনা প্রদানের দাখিলা থাকতে হবে,
  • এই আইনে ব্যক্তির পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার তথা কোম্পানীরও বিচার করা যাবে। সেক্ষেত্রে সংস্থান মালিক, পরিচালক, ব্যবস্থাপক, সচিব বা অন্য যে কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতে নালিশ করা যাবে,
  • এই আইনে রাষ্ট্র কতৃক সাক্ষী সুরক্ষা ব্যবস্থার বিধান রাখা হয়েছে
  • এ আইনে ভূমি সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ প্রস্তুতির নির্দেশনাদেওয়া আছে।

 

লেখক: অ্যাডভোকেট, কুমিল্লা জজ কোর্ট। ই-মেইল: samukim1@gmail.com