মোঃ আরিফ হুসাইন: বিবাহ সম্পাদনে ছেলে-মেয়ে এমনকি অভিভাবকগণও রাজি কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বয়স কারণ ছেলে অথবা মেয়ে কিংবা উভয়ই অপ্রাপ্ত বয়স্ক। এ-ক্ষেত্রে করণীয় কি? অপ্রাপ্ত বয়স্ক হলেই কি আইন বিয়ে-কে নিষিদ্ধ করেছে?
বাল্য বিবাহ নিয়ে আমাদের দেশে Child Marriage Restraint Act 1929 কার্যকর ছিল, পরে তা বাতিল পূর্বক সময়োপযোগী করতে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ প্রণয়ন করা হয়। উক্ত আইনের ১৯ ধারায় অপ্রাপ্ত বয়স্কদের বিয়ের বিশেষ নিয়ম যুক্ত করা হয়েছে।
২০১৭ সালের বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন এর ধারা ২(৩) অনুযায়ী বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলের বয়স ২১ এবং মেয়ের ১৮ বছর নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এই আইনের ১৯ ধারায় বিশেষ কোন পরিস্থিতি, যেমন অপ্রাপ্ত বয়স্কের আত্মহত্যার সম্ভবনা বা অপ্রত্যাশিত ভাবে গর্ভধারণ হলে, মিসক্যারেজ এর সম্ভাবনা থাকলে, সামাজিক নানান অবক্ষয় বা ভ্রুণ হত্যার মত পরিস্থিতি বিবেচনায় এ বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে।
মনে করুন, দশম শ্রেণীর হাবিব ও নবম শ্রেণীর নাতাশা দুইজন প্রেমে পড়লো, এবং তারা শারীরিক সম্পর্কে জড়ালো অতঃপর মেয়েটি গর্ভবতী হলো। এই যে অনাগত গর্ভের সন্তান, তার কি কোন বৈধতা নেই…! এমন পরিস্থিতিতে যদি তাদের বিয়ে দেয়া না হয় বা বিয়ে অস্বীকার করা হয় শুধু এই কারণে যে তারা প্রাপ্ত বয়স্ক নয়, তাহলে মেয়েটির ও অনাগত সন্তানটির ভবিষ্যৎ কি হবে…?
সামাজিক ও বাস্তবিক এমন নানা-রকমের সমস্যা বিবেচনা নিয়ে চিন্তা করলে ১৯ ধারার বিধান অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এমন বিয়ে-কে, বলা যেতে পারে ‘মন্দের ভাল’। সমাজ বাস্তবতায় আইন প্রণেতাগণের বোধ ও প্রজ্ঞার জন্যই এই ‘বিশেষ বিধান’ সংযোজন করা হয়েছে বলেই আমি মনেকরি।
বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ এই আইনের ১৯ ধারার বিশেষ বিধান টি পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, বিশেষ বিধানের আওতায় বিয়ের অনুমতি দিতে ৩টি শর্ত আরোপ করা হয়েছে-
১. আদালতের নির্দেশ (Court’s order) থাকতে হবে।
২. বাবা মা অথবা অভিভাবকের সম্মতি (Consent of Parents or Guardians) থাকতে হবে।
৩. নাবালক বা কম বয়স্কার সর্বোত্তম স্বার্থে (Highest Interest of the Minor) ।
আবার বাল্যবিবাহ নিরোধ বিধিমালা-২০১৮ এর ১৭ বিধি অনুযায়ী বিশেষ বিধান প্রয়োগে দুইপক্ষকে যৌথভাবে আদালতে আবেদন করতে হবে এবং আবেদন করতে পারবেন-
ক. উভয়পক্ষের পিতামাতা,
খ. আইনগত অভিভাবক,
গ. অপ্রাপ্ত বয়স্ক পাত্রপাত্রী সহ উভয়পক্ষ।
আবেদন প্রাপ্তির পরে বিজ্ঞ আদালত আবেদনের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য যাচাই কমিটির কাছে প্রেরণ করবেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (UNO) সভাপতিত্বে ৭ সদস্যের যাচাই কমিটি উক্ত বিয়ের বিষয়ে ১৫ দিনের মধ্যে কোর্টে একটি প্রতিবেদন দাখিল করবেন। এক্ষত্রে আবেদন যাচাই কমিটি দুটি বিষয় বিবেচনায় নিবেন-
১. বিয়েটি অপ্রাপ্ত বয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে (Best Interest) হবে।
২. যখন বিয়েটা হবে সর্বশেষ বিকল্প (Last Alternative) অর্থাৎ অন্য কোন বিকল্প উপায় নেই।
অতঃপর আদালত যদি কমিটির সুপারিশ পেয়ে সন্তুষ্ট হয় তাহলে বিয়ের অনুমতি দিবেন, বা নামঞ্জুর করবেন অথবা পুনরায় তদন্ত করাবেন, এমনকি কমিটিকে আদালতে উপস্থিত করিয়ে তাদের বক্তব্য শুনতে পারেন। এক্ষেত্রে কমিটি চাইলে বিয়ে না হওয়ার সুপারিশ করতে পারে-বিবাহটি যদি জোরপূর্বক হয়, কিংবা অপহরণ, ধর্ষণ বা জোরপূর্বক মিলনের কারনে হয়।
তবে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ১৯ ধারায় এই বিশেষ বিধানের আওতায় বিয়ের অনুমতি পাওয়া সহজ নয়। দুই পক্ষের আবেদনের ভিত্তিতে আদালত অপ্রাপ্ত বয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিত করার পর সাথে সাথে অনুমতি দিবে না বরং যাচাই কমিটি সত্যতা যাচাই করে সুপারিশ করলে এবং আইন ও বিধির শর্ত পূরণ হলেই এই বিশেষ বিধান প্রয়োগ করে অপ্রাপ্তবয়স্কের বিয়ের অনুমতি দিবেন।
কিন্তু ২০১৭ সালের বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন এবং ২০১৮ সালের বিধিতে কোথাও কোন আদালত এমন অনুমতি দিবে তা বলা হয়নি। তবে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ও বিধি একত্রে পড়লে বিষয়টি পরিষ্কার হয় যে, এ বিষয়ে যথাপোযুক্ত ফোরাম হলো বিচারিক ম্যাজিস্ট্রিট আদালত। কেননা বিধিতে সংযুক্ত ফোরাম গুলির মধ্যে ‘বিচারিক আদালত’ ও মোবাইল কোর্ট পৃথক ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়াও ফৌজদারি কার্যবিধির-১৮৯৮ এর ২৯ ধারা ও ২য় তফসিলের ৮ম কলামে উল্লেখিত ‘অন্যান্য আইন বিরোধি চেষ্টা’ নীতিতে ২ বছর পর্যন্ত শাস্তিযোগ্য হওয়ায় এ আইনের অধীন অপরাধের বিচার ও তদন্ত জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট করবেন।
অতীতে বিয়ের ক্ষেত্রে এভিডেভিড করে বয়স বেশি দেখিয়ে কিছু ক্ষেত্রে অপ্রাপ্ত বয়স্ককে বিয়ে দেওয়া হতো। এখন বয়স প্রমাণে এমন এভিডেভিড এর সুযোগ নেই। বিয়েতে বৈধ কাগজপত্র হিসেবে জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয় পত্র, এসএসসি সার্টিফিকেট, জেএসসি সার্টিফিকেট, পিইসি সার্টিফিকেট এবং পাসপোর্ট বিবেচনায় নেওয়া যাবে।
লেখক: লিগ্যাল এক্সিকিউটিভ, প্রিয়াংকা গ্রুপ এবং প্রভাষক, গাজীপুর সেন্ট্রাল ল কলেজ, টংগী।