– মা…আমাকে জেলে পাঠাইস না..মা! আমি ভালো হয়ে যাব..মা।
– না, না, আমি তোর কোনো কথা শুনবো না। তুই আমার কোনো কিছু রাখিস নি।
– মা একটাবার সুযোগ দাও মা। আমি ভালো হয়ে যাব মা – এই কথা বলে আসামী মিঠাই তার মায়ের পা ধরে ফেলল। তার মা তীব্র ঘৃণাভরে পা সরিয়ে নিল। মুখ ফিরিয়ে বলল, ওকে জেলে দেন স্যার। ওকে জেলে দেন।
বুঝতেই পারছেন, আসামী মিঠাই মাদকসেবী। তার মায়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। আমি সেদিন অভিযোগটা দেখেই মধ্যাহ্ন বিরতিতে তাদের মা-ছেলেকে খাস কামড়ায় ডেকেছিলাম। জিজ্ঞাসাবাদে জানলাম, আসামী মিঠাই ইয়াবা খায়, কখনো হেরোইনও নেয়। তার ভিক্ষুক মা মায়া এসেছে তার একমাত্র আদরের ছেলেকে কারাগারে নিক্ষেপ করতে।
মায়া স্থানীয় লোকজনের কাছে শুনেছেন, কয়েক মাস কারাগারে থাকলেই মাদকের নেশা কেটে যাবে। কিন্তু তার মা জানে না, কারাগারে বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীরা থাকে। ছোটখাটো মাদকসেবীরা কারাগারে গিয়ে আরো বড় মাদক ব্যবসায়ী হয়ে বের হয়। কোনো এক হাজতির লেখায় পড়েছিলাম,“দীর্ঘদিন ধরে গাজার পুরিয়া বিক্রি করছিলাম। কিন্তু ব্যবসাটা জমছিল না। আলহামদুলিল্লাহ! জেলখানায় এসে কিছু ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সাথে পরিচয় হয়েছে।”
মিঠাইয়ের মামলাটা ভালভাবে দেখলাম। তার মামলায় মাদক সেবনের একটি অক্ষরও লেখা নেই। অভিযোগ হচ্ছে সে তার মাকে মারপিট করে এক ভরি ওজনের স্বর্ণের চেন বিক্রি করে দিয়েছে। একেবারে ডাহা মিথ্যা কথা। তবুও একই ধরনের অভিযোগে অসংখ্য মিঠাই আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি কারাগারেই আছে। কেউ ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫১ ধারায়, কেউ মাদক সেবনের মামলায়, কেউ আরএমপি/ডিএমপি অর্ডিনেন্স এর মামলায়, কেউবা চুরির মামলায় আটক থাকেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এমনি বছর যাবৎ।
০৩ বছর আগে পত্রিকায় দেখেছিলাম রাজশাহীর তানোর থানাধীন ইব্রাহীম নামের একটি ছেলে মাদকাসক্ত হওয়ায় তার পরিবার পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পুলিশ তাকে মোবাইল কোর্টে উপস্থাপন করলে মাদক সেবনের দায়ে এক বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন (মাদকাসক্ত ছেলেকে পুলিশে দিলেন বাবা, bbarta24.com, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০)। কারা অধিদপ্তরের ২০১৬ সালের তথ্যানুসারে, সারাদেশের ৬৮ কারাগারে এমন মাদকাসক্ত বন্দী ৫৯৭০ জন (কারাগার হচ্ছে মাদক নিরাময় কেন্দ্র, bdnews24.com, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)।
পরিবার থেকে এমন অপরাধীদের কারাগারে প্রেরণের উদ্দেশ্য একটাই মাদকাসক্ত ব্যক্তিটি যেন নেশার কবল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। ইব্রাহীমের মামলাটার খোজ নিলাম সংশ্লিষ্ট থানা থেকে। সিডিএমএস রিপোর্ট অনুসারে উক্ত দণ্ডিত অপরাধী পরবর্তীতে অল্প দিনের ব্যবধানে ইয়াবাসহ হাতে নাতে ধৃত হয়েছেন। একই রকম তথ্য পেলাম রকি নামের আরেক মাদকসেবীর যিনি মাদক সেবনের দায়ে এক বছরের দণ্ড ভোগ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে মাদক সেবনের দায়ে পুলিশ কর্তৃক হাতে-নাতে গ্রেফতার হয়েছেন। উভয়ের মামলা বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
কতটা সাংঘাতিক ব্যাপার-স্যাপার! মাদকসেবী কারামুক্ত হওয়ার পর সংশোধন হওয়ার পরিবর্তে অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে এবং আরো বেশী করে মাদকের সাথে যুক্ত হচ্ছে। সুতরাং মাদকাসক্তি একটি deep-seated problem. মাদকাসক্তদের কয়েক মাস আটক রাখলেই আসক্তি কমে যাবে না, সমস্যার সমাধানও হবে না। তাদের মেডিকেশনের পাশাপাশি বয়ে নিয়ে আসা মানসিক যন্ত্রণারও চিকিৎসা করতে হবে।
উদ্ভূত সমস্যার একটি চমৎকার সমাধান পেলাম ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬ (৪) ধারায়। উক্ত উপধারা অনুসারে, যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি মাদকসেবন ব্যতীত অন্য কোনোরূপ মাদক অপরাধী হিসাবে প্রতীয়মান না হন, তাহলে উক্ত আদালত উক্ত ব্যক্তিকে মাদকাসক্ত ব্যক্তি বিবেচনাপূর্বক যেকোনো মাদকাসক্তি চিকিৎসা কেন্দ্রে স্বীয় অথবা পরিবারের ব্যয়ের মাদকাসক্তি চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করতে পারবেন এবং যদি উক্ত মাদকাসক্ত ব্যক্তি এইরূপ মাদকাসক্তির চিকিৎসা গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, তাহলে তিনি অন্যূন ৬ (ছয়) মাস অনূর্ধ্ব ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রসমূহে লক্ষ টাকার প্যাকেজ। মিঠাইয়ের মত হতদরিদ্রের জন্য সরকারী মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রই ভরসা। তার মামলাটা পাওয়ার পর তার মাকে বললাম, আপনি কি আপনার ছেলের চিকিৎসা করেছেন? আপনি কি জানেন, আপনার ছেলের কারাগার অপেক্ষা চিকিৎসা জরুরী। উত্তরে বললেন, বাবা, সবই বুঝলাম। কিন্তু চিকিৎসা করতে তো অনেক টাকা লাগে। বললাম, কোনো টাকা লাগবে না। আপনি শুধু আপনার ছেলের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসেন।
তাৎক্ষনিকভাবে ফোন করলাম রাজশাহীর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আলমগীর সাহেবকে। তিনি ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে আদালতে উপস্থিত হলেন। তার মাধ্যমে কথা বললাম সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের চিকিৎসকের সাথে। তিনি জানালেন, মিঠাইকে ২৮ দিনের কোর্সে ভর্তি করা যাবে। তাকে সেই দিনেই ভর্তি করা হলো। ঠিক ১৪ দিন পর আমি ব্যক্তিগতভাবে উনাকে ফোন দিলাম। তিনি জানালেন, প্রথম প্রথম তার খাবারে অরুচি ও ঘুমের সমস্যা ছিল। কয়েক দিন তাকে বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল। এখন তার খাবার রুচি বেড়েছে এবং পরিমিত ঘুম হচ্ছে। ঔষধের ডোজ কমানো হয়েছে। তার সাথে নিয়মিত কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। আস্তে আস্তে সে স্বাভাবিক হচ্ছে।
নিঃসন্দেহে মাদকাসক্তদের সংশোধনের জন্য কারাগারে আটক রাখার চেয়ে নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা গ্রহণ অনেক বেশি ইতিবাচক পদ্ধতি। এটি অত্যন্ত আশাপ্রদ যে, আমাদের কারা কর্তৃপক্ষ নিজেরাই সমস্যাটা চিহ্নিত করতে পেরেছে। বর্তমানে দেশের ৬৮টি কারাগারে ‘মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তবে কারাগারে বন্দিদের দ্বিগুণ চাপ, স্বাস্থ্য ঝুঁকি, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও কাউন্সিলরের অভাব ইত্যাদি কারণে তাদের আসক্তি থেকে মুক্তি মেলা কঠিন হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, মাদক নিরাময় কেন্দ্র অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ অবস্থা থেকে পরিত্রান দিতে পারে। এজন্য কমপক্ষে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা অত্যাবশ্যক।
পুনশ্চ, চিকিৎসার ২৮ দিন পর মিঠাই নিরাময় কেন্দ্র থেকে মুক্তি পেয়েছে। আজ কথোপকথনে বোঝা গেল সে আগের মত অস্থির নয়। বেশ শান্তভাবে বুঝে শুনে উত্তর দিচ্ছে। হতাশাগ্রস্ত মিঠাইকে অনেক আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে। মিঠাইয়ের মাও বেজায় খুশী । তিনি আজ আর ছেলেকে কারাগারে নিক্ষেপ করতে আসেন নি, এসেছেন ছেলের বিরুদ্ধে আনীত মামলা প্রত্যাহার করতে।
বি.দ্র. ঘটনা সত্য। আসামীর ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
লেখক: মো: সাইফুল ইসলাম পলাশ, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী।