বিচার বিভাগ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পাঁচটি কর্মপ্রণালী নির্ধারণ করেছেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। বুহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) সুপ্রিম কোর্ট অডিটোরিয়ামে আয়োজিত প্রথম সভায় এসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্বগ্রহণের পর আমি আমার উদ্বোধনী ভাষণে বলেছিলাম যে, বিচার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রমের জন্য আমি সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বসবো। সবার মতামতের ভিত্তিতে একটি দীর্ঘমেয়াদি বৃহত্তর পরিকল্পনার প্রস্তাব প্রণয়ন করবো। তাই আজ আমরা সেই পরিকল্পনার প্রথম মিটিংয়ে মিলিত হলাম।’
তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা এই কার্যক্রমের নাম দিয়েছি— দীর্ঘমেয়াদি বিচার বিভাগীয় পরিকল্পনা। আমি মনে করি, বিচার বিভাগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার যারা— অর্থাৎ বিজ্ঞ আইনজীবী, তাদের নিয়েই আজ আমাদের শুরুর মিটিং অনুষ্ঠিত হচ্ছে।’
পাঁচ পরিকল্পনা
প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনাদের নিয়ে আজ এখানে আমাদের মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট। আমাদের উদ্দেশ্য হলো— এক. বিচার বিভাগ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে। দুই. আদালতের কার্যক্রম তথা বিচার ব্যবস্থা গতিশীল করতে হবে। তিন. বিচারকাজের মানবৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় গবেষণামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। চার. বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের (যেমন- বিচারক ও কোর্টের স্টাফ) দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং উপরিউক্ত উদ্দেশ্যগুলো অর্জন করতে হবে। পাঁচ. প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে সুপ্রিম কোর্ট উদ্বোধনীর দিন এই সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আইনের শাসন, মানুষের অধিকারের সুরক্ষা, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ও উপদেশ আমাদের দিয়েছিলেন। আমরা তার সেই দার্শনিক ভাষণে বিচার বিভাগের জন্য উপযুক্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেখতে পাই। তিনি তার সেই ভাষণে বাংলায় রায় লেখার কথাও বলেছিলেন।’
সভায় উপস্থিত সবার উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা জানেন যে, দেরিতে হলেও প্রযুক্তির সহযোগিতায় সব রায় বাংলা করার উদ্যোগ আমরা গ্রহণ করেছি। বঙ্গবন্ধু তাঁর সেই ভাষণে বলেছিলেন, এই অঙ্গনে শহীদ আইনজীবীদের একটি তালিকা থাকলে ভালো হয়। আমরা তাঁর সেই নির্দেশও বাস্তবায়ন করেছি। বলা যায়, বিচার বিভাগ বিষয়ক আজকের এই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের পেছনেও আমরা জাতির পিতার সেসব দিকনির্দেশনার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। কিন্তু এই কাজ একা প্রধান বিচারপতি করতে পারবে না। বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্ট সব ধরনের অংশীজনদের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে এই পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে।’
‘আপনারা সবাই বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ আইনজীবী। বিচার বিভাগে আপনাদের পদচারণা দীর্ঘদিনের। আপনাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ এই কাজে সবচেয়ে বড় সহায়ক উপাদান হিসেবে কাজে লাগবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমরা ধাপে ধাপে সব অংশীজনের সঙ্গে বসবো, কথা বলবো, তাদের মতামত ও প্রস্তাব সংগ্রহ করবো।’
প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘বিচারব্যবস্থা নিয়ে অনেক অভিযোগ আছে। কিন্তু এসব অভিযোগ নিরসনের জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা প্রয়োজন এবং এসব সমস্যা নিরসনের জন্য কার্যকর মেকানিজম বা পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। এই পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে আমরা সেগুলো চিহ্নিত করবো।’
তিনি বলেন, ‘আপনারা সবাই আপনাদের সুচিন্তিত মতামত ও প্রস্তাব দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করবেন। আপনাদের মতামত ও প্রস্তাব দুভাবে আমাদের কাছে প্রেরণ করা যাবে। প্রথমত, এখানে উপস্থিত যারা কোনও প্রতিষ্ঠানকে প্রতিনিধিত্ব করছেন, তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আপনাদের লিখিত প্রস্তাব পাঠানোর জন্য অনুরোধ করছি। দ্বিতীয়ত, যারা এখানে ব্যক্তি হিসেবে অংশগ্রহণ করেছেন, তারা তাদের নিজেদের মতামত লিখিতভাবে আমাদের কাছে পাঠাবেন, সেই অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রস্তাব ও মতামত পাঠানোর ঠিকানা— রেজিস্ট্রার জেনারেল, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।’
ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘মতামত বা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে কোনও কৃপণতা নেই। আপনাদের মনে বিচার বিভাগের উন্নয়নমূলক যত ধরনের চিন্তা আসে, সেসবের সবকিছু আপনাদের মতামতে তুলে ধরতে পারবেন। এভাবে সব অংশীজনের কাছ থেকে আমরা এক এক করে মতামত ও প্রস্তাব সংগ্রহ করবো। পরবর্তীকালে এসব মতামত ও প্রস্তাব নিয়ে কয়েকটি ধাপে আলোচনা, বিশ্লেষণ ও গবেষণা করে একটি চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। এই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা একটি রিপোর্ট বা বই আকারে মুদ্রণ করে আপনারাসহ সবার সঙ্গে শেয়ার করা হবে।’
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা সবাই একটি সুন্দর, সক্ষম ও সচল বিচার বিভাগ চাই। আমাদের এই পরিকল্পনা নিখুঁত হবে না জানি, কিন্তু পথচলার জন্য পরিকল্পনা থাকা আবশ্যক। ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য এই পরিকল্পনা আমরা একটি দিকনির্দেশনা হিসেবে রেখে যাবো। এর অনেক কিছুই তাদের পথ চলতে সহায়ক হবে। আবার সময়, পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের তাগিদে ভবিষ্যতে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এই পরিকল্পনার সঙ্গে প্রয়োজনীয় যোজন-বিয়োজন করে পরিকল্পনাটিকে আরও সময়োপযোগী করতে সক্ষম হবেন। আমি মনে করি, এভাবে আমরা একটি গণমুখী ও জনবান্ধব বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজ আমরা এখানে যারা উপস্থিত আছি, ভবিষ্যতে তারা কেউ থাকবো না। কিন্তু আমাদের যৌথ শ্রমে, মেধায় ও চিন্তায় রচিত এই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ভবিষ্যতের বিচার বিভাগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পাথেয় হিসেবে কাজ করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।’
প্রধান বিচারপতি বলেন,‘আপনারা জানেন যে, আমি নিজে আইনজীবী ছিলাম। আজ প্রধান বিচারপতি হিসেবে আপনাদের সামনে কথা বললেও এক অর্থে আমি এই ঐতিহ্যবাহী বার-এর একজন সদস্য। আইনজীবীদের জ্ঞান, মেধা ও প্রজ্ঞার প্রতি আমি সবসময়ই শ্রদ্ধাশীল ছিলাম, এখনও আছি। আমি মনে করি, আইনজীবীদের পক্ষে বিচার ব্যবস্থার ত্রুটি- বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা যেভাবে তুলে ধরা সম্ভব, তা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমাদের এই পরিকল্পনা প্রণয়নের বেশিরভাগ সাফল্য নির্ভর করছে আপনাদের ওপর। আইনজীবীদের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার ওপর আমি সবসময়ই আস্থাবান ও নির্ভরশীল। আপনারা যারা আজ এখানে উপস্থিত আছেন, তাদেরকে আমি বৃহত্তর আইনজীবী সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে আহ্বান জানিয়েছি,—আপনারা সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। সেজন্য অশেষ ধন্যবাদ। সময় ও সামর্থ্য থাকলে আমি সব আইনজীবীকে নিয়েই বসতাম। কিন্তু এই জাতীয় কাজে ব্যক্তি পর্যায়ে সবাইকে যুক্ত করা সম্ভব হয় না। তবে, এখানে উপস্থিত নেই এমন যেকোনও আইনজীবীও ইচ্ছে করলে তার মতামত আমাদের বরাকাছে পাঠাতে পারবেন।
সভায় উপস্থিত ছিলেন— আপিল বিভাগের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. কামাল হোসেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সিনিয়র অ্যাডভোকেট এম. আমীর-উল ইসলাম, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট এএফ হাসান আরিফ, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট ফিদা এম কামাল, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সিনিয়র অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি সিনিয়র অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল সিনিয়র অ্যাডভোকেট এস এম মুনীর, শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ ও মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক মমতাজ উদ্দিন মেহেদী এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক মো. আবদুন নূর।