লালসালু ঘেরা প্রচলিত এজলাসে বিচার কার্যক্রম হয়নি। এদিন শিশু আইন অনুযায়ী শিশুদের জন্য আলাদা এজলাস তৈরি করা হয় আদালতে। সেখানে ছিল না আসামি ও সাক্ষীর কাঠগড়া।
বিচারক বসেননি তার জন্য নির্ধারিত প্রচলিত এজলাসের চেয়ারে। সরকারি কৌঁসুলি ও আইনজীবীদের কারও গায়ে ছিল না কোট, গাউন। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের পরনে ছিল না ইউনিফর্ম।
এজলাসের ভেতর বিচারক ও সরকারি কৌঁসুলি ছোট ছোট টেবিলে বসেন। সামনে আইনজীবীরা তাদের নির্ধারিত আসনে। এজলাসের ভেতরে ছিলেন না কোনো পুলিশ সদস্য। শিশুবান্ধব পরিবেশে শিশুদের মামলার বিচার কার্যক্রম হয়।
সোমবার (২৩ অক্টোবর) চট্টগ্রাম আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ ও শিশু আদালত চট্টগ্রামের বিচারক ফেরদৌস আরার আদালতের সামনে এই চিত্র দেখা গেছে।
অন্যদিন বিচারক এজলাসে বসলেও নেমে এসেছেন ভবনের নিচে। আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুদের বসানো হলো টুলে। এজলাসের নিচে বিচারক চেয়ার-টেবিল বসিয়ে কথা বললেন শিশুদের সঙ্গে।
এদিন বাহিনীর পোশাক পরে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন পুলিশের এক সদস্য। তবে শিশু আইন অনুযায়ী তাকে বাহিনীর পোশাক খুলে স্বাভাবিকভাবে সাক্ষ্য দিতে হয়েছে, যেন তিনি যে পুলিশ এটা শিশুরা বুঝতে না পারেন।
চট্টগ্রামের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এভাবে শিশু আদালত গড়ে তোলায় খুশি শিশুদের পরিবার, আইনজীবী ও আদালত সংশ্লিষ্টরা। এভাবে প্রতি মাসে চারবার এই ট্রাইব্যুনালে শিশু আদালত বসবে।
কাগজেই সীমাবদ্ধ ছিল এ নিয়ম
জানা গেছে, আগে প্রথম অতিরিক্ত জেলা বা মহানগর দায়রা জজ আদালতে আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুদের বিচার হতো। ২০২০ সালে আইন সংশোধন করে দেশের সবগুলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালকে শিশু আদালত হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
শিশু আইনে শিশুদের জন্য আদালত কীভাবে গড়ে উঠবে তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এতদিন কাগজেই সীমাবদ্ধ ছিল এ নিয়ম। যথাযথভাবে বড়দের মতো শিশুদের বিচার হতো আদালতে।
তবে সোমবার সপ্তম চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে প্রথমবারের মতো এ আইনের নিয়ম মেনে শিশু আদালত বসানো হয়।
এ উপলক্ষ্যে পর্দা দিয়ে মোড়ানো হয় সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম ফেরদৌস আরার এজলাস। যাতে লালসালু মোড়ানো এজলাস শিশুরা দেখতে না পায়। একই রকম পর্দা দিয়ে বেঞ্চ সহকারী, সাক্ষীদের দাঁড়ানোর মঞ্চ ও কাঠগড়া মোড়ানো হয়।
এদিন আইনজীবীদের সঙ্গে টুলে দুজন শিশুকে এনে বসানো হয়। বিচারক এজলাস ছেড়ে নেমে টেবিলে বসে পরিচালনা করেন কার্যক্রম। তিনি নিজেই শিশুদের সঙ্গে কথা বলেন। অর্থাৎ অভিযুক্ত কোনো শিশু বুঝতেই পারছেন না তাকে কোন আদালতে হাজির করা হয়েছে।
শিশু ও স্বজনের বক্তব্য
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের একটি মামলায় শুনানি শেষে ১২ বছরের এক শিশু আদালতের বারান্দায় যখন আসে, তখন তার চোখে সেই বিমর্ষ ভাবটা আর নেই। নির্ভার তার স্বজনেরাও। শুধু ১২ বছরের ওই শিশু নয়, বিচারাধীন মামলায় এদিন আদালতে হাজির হওয়া শিশু–কিশোরদের সবাইকে দেখা গেছে ভিন্ন চেহারায়।
১২ বছরের ওই শিশু আদালতের বারান্দায় বলে, ‘আমি এখন জামিনে আছি। শুনানিকালে বিচারক আমাকে বাবা বলে সম্বোধন করে বলেছেন, যাতে নতুন করে অপরাধে না জড়াই। আমি তাঁর কথা রাখার চেষ্টা করব।’
মামলায় শুনানি শেষে শিশুটি বলে, ‘আগে কোর্টে (আদালতে) আসলে ভয় পেতাম। আজকে ভয় লাগেনি।’
শিশুটির বাবা বলেন, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ইয়াবা ব্যবসার বাহক হিসেবে জড়িয়ে পড়ে তাঁর ছেলে। ওই ঘটনার পর তারা এখন সচেতন। এক মাস আগেও সদরঘাট থানার মাদক মামলায় হাজিরা দিতে এসেছিল তার ছেলে।
তিনি বলেন, যতবারই আদালতে এসেছে, আতঙ্কের মধ্যে ছিল। এবার তাঁর ছেলে ভয় পায়নি। বরং নিজেকে এই পরিবেশ পেয়ে সংশোধনের জন্য গড়ে তুলবে বলে জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
নগরের সদরঘাট থানার একটি মাদকের মামলায় সোমবার আদালতে সাক্ষ্য দেন পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) নয়ন বড়ুয়া। বর্তমানে তিনি কোতোয়ালি থানায় কর্মরত। তাঁকেও সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। বিচারক ও আইনজীবীদের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি এই মামলার সাক্ষ্য দেন।
সাক্ষ্য শেষে বেরিয়ে আদালতের বারান্দায় নয়ন বড়ুয়া বলেন, ২১ বছরের চাকরিজীবনে অনেক মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। এর মধ্যে শিশু মামলাও ছিল। কিন্তু আজ জীবনে প্রথম তিনি অন্যভাবে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ ও শিশু আদালত চট্টগ্রামের বেঞ্চ সহকারী কফিল উদ্দিন বলেন, সোমবার ২৬টি মামলার শুনানি হয়েছে। প্রতি মাসের চার দিন শুধু শিশুদের মামলার বিচার কার্যক্রম চলবে। যাতে ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন খুন, ধর্ষণসহ অন্য মামলার আসামিদের সংস্পর্শে শিশুরা না আসে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ ও শিশু আদালত চট্টগ্রামের সরকারি কৌঁসুলি এম এ নাসের চৌধুরী বলেন, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে চট্টগ্রামেই প্রথম শিশু আইন অনুযায়ী আলাদাভাবে শিশুদের মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, দাগি অপরাধীদের সঙ্গে শিশুদের বিচারকাজ হচ্ছে না। এতে শিশুদের মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। আগামী দিনের কান্ডারি এসব শিশু ইতিবাচক চিন্তা করতে পারবে।
নাসের চৌধুরী আরও বলেন, শুনানিকালে বিচারক মামলার আসামি প্রতিটি শিশু–কিশোরকে ভবিষ্যতে নতুন করে অপরাধে না জড়াতে উদ্বুদ্ধ করছেন। ভালো হয়ে চলতে কার কী সমস্যা, তা জানার চেষ্টা করছেন। প্রয়োজনে শিশুদের অভিভাবকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন।
জেলা লিগ্যাল এইডের প্যানেল আইনজীবী অ্যাডভোকেট এএফএম সালাউদ্দিন বলেন, আইন অনুযায়ী চট্টগ্রামে প্রথম শিশু আদালত সাজানো হয়েছে। সোমবার শিশুরা বুঝতে পারেনি তাকে আদালতে হাজির করা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে বিচারকার্য চলছে। ধীরে ধীরে সব শিশু আদালত এভাবে গড়ে তোলা উচিত। এতে শিশুরা দ্রুত সংশোধনের সুযোগ পাবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এসএম দিদার উদ্দিন বলেন, আইনে থাকলেও এভাবে শিশু আদালত পরিচালনা করতে আগে দেখা যায়নি। চট্টগ্রামের সপ্তম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে সোমবার প্রথমবারের মতো শিশুদের জন্য আদালত গড়ে তোলা হয়েছে। অন্যান্য জেলায়ও শিশু আদালত এভাবে গড়ে তোলা উচিত।
যা আছে শিশু আইনে
২০১৩ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করা হয়। ২০১৮ সালে আইনটির কয়েকটি ধারা সংশোধন করা হয়। সংশোধিত আইনে শিশুদের জন্য আলাদা আদালত বা পৃথক এজলাসের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
২০১৩ সালের শিশু আইনের ১৭(৪) ধারায় বলা হয়েছে, যেসব দালান বা কামরায় এবং যেসব দিবস ও সময়ে প্রচলিত আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, তাছাড়া যতদূর সম্ভব, অন্য কোনো দালান বা কামরায়, প্রচলিত আদালতের মতো কাঠগড়া ও লালসালু ঘেরা আদালতকক্ষের পরিবর্তে একটি সাধারণ কক্ষে এবং অন্য কোনো দিবস ও সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ব্যতীত শুধু শিশুর ক্ষেত্রে শিশু-আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠান করতে হবে।
একই আইনের ১৯ (২) ধারায় বলা হয়েছে, শিশু আদালতের আসন বিন্যাস এমনভাবে করতে হবে যেন সব শিশু বিচার প্রক্রিয়ায় মাতা-পিতা বা তাদের উভয়ের অবর্তমানে তত্ত্বাবধানকারী অভিভাবক বা কর্তৃপক্ষ বা আইনানুগ বা বৈধ অভিভাবক বা বর্ধিত পরিবারের সদস্য এবং প্রবেশন কর্মকর্তা ও আইনজীবীর, যতদূর সম্ভব, সন্নিকটে বসতে পারে।
১৯(৩) ধারায় বলা হয়েছে আদালতকক্ষে শিশুর জন্য উপযুক্ত আসনসহ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য, প্রয়োজনে, বিশেষ ধরনের আসন প্রদানের বিষয়টি শিশু-আদালত নিশ্চিত করবে।
১৯ (৪) ধারায় উল্লেখ রয়েছে অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, শিশু আদালতে বিচার চলাকালীন, আইনজীবী, পুলিশ বা আদালতের কোনো কর্মচারী আদালতকক্ষে তাদের পেশাগত বা দাপ্তরিক ইউনিফর্ম পরিধান করতে পারবেন না।
জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন চট্টগ্রাম আদালতে কর্মরত প্রবেশন কর্মকর্তা মনজুর মোরশেদ বলেন, আলাদা এজলাসে শিশুবান্ধব পরিবেশে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে চট্টগ্রামের একটি শিশু আদালতে। এতে শিশুদের মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।