মোঃ রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী: সাধারণত কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি গ্রেফতারের আদেশ না হয়, তবে ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা যায় না। পুলিশের কাছে অবশ্যই আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা (অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট) থাকতে হবে। তবে এই পরোয়ানা ব্যতীতও সুনির্দিষ্ট কিছু কারণে একজন ব্যক্তিকে পুলিশ বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে গ্রেপ্তার করতে পারেন। দেশের প্রচলিত বিভিন্ন আইনে পুলিশের সে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে।
যে অপরাধগুলো করলে পুলিশ অফিসার বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারেন
- কোন আমলযোগ্য অপরাধ করলে
- আইনসঙ্গত কারণ ব্যতীত যার কাছে ঘর ভাঙার কোনো সরঞ্জাম পাওয়া গেলে
- আদালত কর্তৃক ঘোষিত কোন অপরাধীকে
- কারো কাছে চোরাইমাল পাওয়া গেলে
- পুলিশের আইনানুগ কাজে কেউ বাধা দিলে
- সামরিক বাহিনী হতে কেউ পলায়ন করলে
- কেউ বিদেশে অপরাধ করে দেশে ফিরে আসলে কিন্তু প্রচলিত আইনে অপরাধ হলে
- কোন জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত আসামী অত্র আইনের ৫৬৫(৩) ধারা লংঘন করলে
- পুলিশ অফিসারের নিকট হতে কাউকে গ্রেফতারের জন্য অনুরোধ পত্র পাওয়া গেলে
- থানা এলাকায় কোন ভবঘুরে সন্দেহভাজন ব্যক্তি ঘোরাফেরা করলে এমন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা তার অধীনস্ত কোন অফিসারকে দিয়ে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করাতে পারেন
- পুলিশ অফিসারের সামনে কেউ আমলের অযোগ্য অপরাধ করলে সেই অপরাধীর নাম ঠিকানা জিজ্ঞাসা করার পর সে যদি তার আসল নাম ঠিকানা না জানায় তাহলে নাম ঠিকানা যাচাই করার জন্য তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যায়
- জনসাধারণের সামনে কেউ আমলযোগ্য অপরাধ করলে বা কাউকে আমলযোগ্য অপরাধী বলে মনে হলে বা সরকার কর্তৃক ঘোষিত কোন অপরাধীকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারবেন
- পুলিশ অফিসারের সামনে কেউ আমলযোগ্য অপরাধ করলে পুলিশ অফিসার সেই অপরাধ নিবারনের জন্য ১৪৯ ধারা মোতাবেক ব্যবস্থা নিয়েও যদি নিবারণ করা না যায়, সেক্ষেত্রে পুলিশ অফিসার উক্ত অপরাধ নিবারণের জন্য বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারেন
- কোন মামলার বাদী বা সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়ার জন্য আদালত কর্তৃক বরাবর সমন দেওয়ার পরও যদি উক্ত সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিতে না যায়
- কোন জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত আসামীর যে সকল শর্তে জামিন মঞ্জুর করা হয়েছিল সে সকল শর্ত লংঘন করলে জামিন বাতিল পূর্বক বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যায়
- থানা এলাকায় কোন ব্যক্তি পুলিশ আইনের ৩৪ ধারা এবং ৩৪-ক ধারার অপরাধ করলে থানার পুলিশ অফিসার উক্ত অপরাধীকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারেন
আরও পড়ুন: গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির আইনগত অধিকার
বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারে আছে আরো আইন
উল্লেখিত ক্ষমতা পুলিশ ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ধারা ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭(১), ৫৯(১), ১৫১, ১৭১, ৪০১(৩) ধারা, পুলিশ আইন ৩৪, ৩৪-ক ধারা, অস্ত্র আইন ১২ ধারা মতে প্রয়োগ করতে পারে। এছাড়াও নিম্নবর্ণিত আইনে বিনা পরোয়ানায় একজন ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে; ডিএমপি ১০০ ধারা, মাদক আইন ৩৮ ধারা, মানব পাচার ২০ ধারা, বিস্ফোরক আইন ১৩ ধারা, রেলওয়ে আইন ১৩১, ১৩২ ধারা, পিআরবি ৩১৬ বিধি। মটরযান আইনের বেশকিছু ধারার অপরাধ করলে উক্ত অপরাধীকে পুলিশ অফিসার বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারেন।
আরও পড়ুন: তল্লাশী ও আটকে নাগরিক অধিকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর করণীয়
যে ক্ষেত্রগুলোতে পুলিশ যুক্তিসংগত সন্দেহের ভিত্তিতে কোন ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করলে, সেক্ষেত্রে উক্ত ‘যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ’ এবং ‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্য’ অবশ্যই সুনির্দিষ্ট তথ্যের সাথে সম্পর্কিত হতে হবে, যা একজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার আগে পুলিশ অফিসারকে অবশ্যই সার্বিকভাবে বিবেচনা করতে হবে। অন্য কথায়, এই ধরনের তথ্য প্রাপ্তির পর পুলিশ অফিসারের অবশ্যই সুনির্দিষ্ট এবং আন্তরিক বিশ্বাস থাকতে হবে যে, একটি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা সংঘটিত হতে চলেছে, এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা অতীব প্রয়োজন। যদি একজন পুলিশ অফিসার অন্যায়ভাবে একজন ব্যক্তিকে যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি এবং প্রকৃত বিশ্বাস ছাড়া গ্রেপ্তার করে তাহলে দণ্ডবিধির ২২০ ধারার অধীনে অপরাধ সংঘটিত করে।
বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের বিষয়ে পুলিশের জন্য ১০টি ও ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য ৯টি নির্দেশনা দিয়েছেন (৬৯ ডিএলআর (এডি) ৬৩)। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য ১০টি নির্দেশনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হলো;
- কাউকে কোথায় থেকে কত তারিখে কখন গ্রেফতার করা হয়েছে তা একটি মেমোরেন্ডামে উল্লেখ করতে হবে ও তাতে গ্রেফতারকৃত ব্যাক্তির স্বাক্ষর নিতে হবে। গ্রেফতারকৃত ব্যাক্তির আত্মীয়-স্বজনকে ১২ ঘন্টার মধ্যে জানাতে হবে।
- গ্রেফতারের সুনির্দিষ্ট কারণ থাকতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পরিচয় প্রকাশ করতে হবে।
- কেউ পুলিশের বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়পত্র দেখতে চাইলে তা দেখাতে হবে।
- অসুস্থ হলে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
- বাসা থেকে গ্রেফতার করা না হলে আত্মীয়-স্বজনকে ১২ ঘন্টার মধ্যে লিখিতভাবে জানাতে হবে।
- গ্রেফতারকৃত ব্যাক্তিকে তার আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করতে দিতে হবে বা আত্মীয়-স্বজনের দেখা করতে দিতে হবে।
- রিমান্ড আবেদন করলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে কেন তদন্ত শেষ হয়নি তা উল্লেখ করতে হবে।
আরও পড়ুন: গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির সতর্কতা ও করণীয়
আপিল বিভাগের এসব নির্দেশনা মানা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য বাধ্যতামূলক। আপিল বিভাগের এসব নির্দেশনা না মানলে পুলিশের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করা যাবে। তবে শর্ত থাকে যে, অতি দ্রুত গ্রেপ্তারকৃত উক্ত ব্যক্তিকে পুলিশ অফিসার সংশ্লিষ্ট থানায় এবং যথানিয়মে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করতে হবে।
লেখক: অ্যাডভোকেট; বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।