দীপজয় বড়ুয়া: সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ অনুযায়ী সাক্ষ্য বা ‘evidence’ হচ্ছে, আদালত কর্তৃক. কোন বিচার কার্য সম্পাদনের সময় পক্ষগণ কর্তৃক তাদের সাক্ষীর মাধ্যমে’ বা রেকর্ড, দলিল ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের বক্তব্য সম্পর্কে আদালতের মনে বিশ্বাস স্থাপনের প্রয়াসে আইনভাবে উপস্থাপিত প্রমাণের নমুনা।
‘সাক্ষ্যের’ ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘evidence’ ল্যাটিন শব্দ ‘evidens’ বা ‘evidere’ হতে উদ্ভূত। এর অর্থ হচ্ছে সুস্পষ্টভাবে কোন কিছু প্রদর্শন করা বা দৃষ্টি গোচর করা বা সুস্পষ্টভাবে আবিষ্কার করা। অতএব বিচারাধীন কোন ঘটনা সম্পর্কে প্রমাণ বা অপ্রমাণের উদ্দেশ্যে উপস্থাপিত কোন বক্তব্য বা বস্তু। যে ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান করেন তাকে সাক্ষী বলে এবং সাক্ষ্য দ্বারা যে ঘটনা প্রতিষ্ঠিত করা হয় তাকে প্রমাণিত বলে। সাক্ষ্যের শাখা বিশেষ বা অংশকে প্রমাণ বলে।
প্রত্যেকটি মামলা আদালতে প্রমাণ করার জন্য প্রয়োজন হয় বিভিন্ন রকমের প্রমাণ বা সাক্ষ্যের। এই সাক্ষ্যগুলোকে প্রধানত তিনভাগে ভাগ করা হয় : ১. দালীলিক সাক্ষ্য, ২. মৌখিক সাক্ষ্য এবং ৩. পরিস্থিতিগত সাক্ষ্য। এই তিন ধরনের সাক্ষ্যের গুরুত্ব সবসময় একরকম নয়। বিশেষ করে এই তিন ধরনের সাক্ষ্যের মধ্যে মৌখিক সাক্ষ্যকে অকাট্য হিসেবে প্রমাণ করতে হলে আইনের অধীনে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়।
সাক্ষ্য আইনে মৌখিক সাক্ষ্য
সাক্ষ্য আইনের ৩ ধারায় মৌখিক সাক্ষ্যের বা Oral Evidence এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে, আদালতে যে ঘটনার বিচার হচ্ছে, সে সম্পকের্ সাক্ষীকে যেসব বিবৃতি দেয়ার জন্য আদালত অনুমতি দেন বা বিচারের জন্য তার যেসব বিবৃতি আদালতের প্রয়োজন হয়, এসব বিবৃতিকে বলা হয় মৌখিক সাক্ষ্য।
একই আইনের ৫৯ ধারায় বলা হয়েছে যে, দলিলের বিষয়বস্তু ছাড়া সব বিষয়ে মৌখিক সাক্ষ্য দিয়ে মামলা প্রমাণ করা যেতে পারে। একই আইনের ৬০নং ধারায় বলা হয়েছে যে, মৌখিক সাক্ষ্যকে সব ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রত্যক্ষ হতে হবে। অথার্ৎ সেটি যদি এমন বিষয় সম্পর্কে হয়, যা দেখা যেতে পারে; তাহলে যে সাক্ষী বলবে যে, সে তা দেখেছে তা সেই সাক্ষ্যে স্পষ্ট করে বলতে হবে। সেটি যদি এমন বিষয় সম্পকের্ হয় যা শোনা যেতে পারে তবে যে সাক্ষী বলবে যে, সে তা শুনেছে, তাহলে তা সেই সাক্ষ্যে স্পষ্ট করে বলতে হবে। সেটি যদি এমন কোনো বিষয় সম্পকের্ হয়, যা অন্য কোনো ইন্দ্রিয় দ্বারা অন্য কোনোভাবে উপলব্ধি করা যেতে পারে, তবে যে সাক্ষী বলবে যে, সে তা সেই ইন্দ্রিয় দিয়ে বা সেই উপায়ে উপলব্ধি করেছে, তা সেই সাক্ষ্যে স্পষ্ট করে বলতে হবে।
সাক্ষ্যে উল্লিখিত বিষয়বস্তু যদি কারও অভিমত অথবা অভিমতের ভিত্তিতে হয়, তবে যে ব্যক্তি সেই ভিত্তিতে সেই অভিমত পোষণ করে, তা সেই সাক্ষ্যে স্পষ্ট করে বলতে হবে। তবে বিশেষজ্ঞের অভিমত সংবলিত গ্রন্থ যদি সাধারণভাবে বা সহলভ্যভাবে প্রাপ্ত হয়ে, সে ক্ষেত্রে সেই অভিমত এবং যে যুক্তির ওপর তা প্রতিষ্ঠিত, সেটির প্রমাণের জন্য সেই গ্রন্থটি উপস্থাপন করা যেতে পারে, যদি সেই গ্রন্থের প্রণেতার মৃত্যু হয়ে থাকে অথবা যদি তার সন্ধান পাওয়া না যায় অথবা যদি তিনি সাক্ষ্য দিতে অসমথর্ হয়ে থাকেন অথবা যদি তাকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত করতে এরকম বিলম্ব ও ব্যয় হয় যা আদালত অযৌক্তিক বলে বিবেচনা করেন।
মৌখিক সাক্ষী সম্পর্কে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলার সিদ্ধান্ত নিম্নরূপ
AIR 1956 SC 277 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “কোন সাক্ষীর সাক্ষ্য আংশিক মিথ্যা হইলেই সর্বাংশ মিথ্যা হইবে ইহা আইনের কোন সুষ্ঠ নীতি নহে।”
PLD 2001 SC 222 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “আদালতের কর্তব্য হইবে নিষ্প্রয়োজনীয় অসংলগ্নতা ও উন্নতি বিধান খুঁজিয়া দেখার চেয়ে সাক্ষ্যের স্বকীয় মূল্য বিবেচনা করে।”
53 DLR(AD) 1 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “কোন সাক্ষীর সাক্ষ্য আংশিক মিথ্যা হইলেই সর্বাংশ মিথ্যা হইবে ইহা আইনের কোন সুষ্ঠ নীতি নহে”।সেই হেতুতে সাক্ষীর সাক্ষ্য আংশিক মিথ্যা হইলে উহা বাতিল করা যাইবে না।”
8 MLR 132 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “পরস্পরবিরোধী বক্তব্য বাদীর মামলার জন্য মারাত্নক হইতে পারে, তবে সাক্ষ্যে গৌণ অমিল বা পার্থক্য বাদীর মামলাকে সন্দেহজনক করিবে না। তুচ্ছ ধরনের অমিল, সাংঘর্ষিক, বিচ্যুতি অসংলগ্নতা সাক্ষীকে মুছিয়া ফেলিবে না যদি উহা অন্যভাবে গ্রহণযোগ্য হয়।”
25 BCR(AD) 265 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “পরস্পর বিরোধী বক্তব্য মামলার জন্য মারাত্নক তবে বক্তব্যে অমিল মারাত্নক নহে। আপীল বিভাগের পর্যবেক্ষণ হইল যে, অসামঞ্জস্য বক্তব্য হইল এক হয় অপ্রাসঙ্গিক, নাহয় অসংলগ্ন তবে খাপ খাওয়ানো অসম্ভব নহে। অপরদিকে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য হইল সংঘর্ষশীল এবং খাপ খাওয়ানোর মতো নহে।”
তবে সাক্ষ্য আইনের ৩২ ও ৩৩ ধারায় এরূপ নীতির ব্যতিক্রম করা হয়েছে
সাক্ষ্য আইনের ৩২ ধারা মতে, কোন নিহত ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে যদি তার মৃত্যুর কারণ, অবস্থা এবং পরিস্থিতি বর্ণনা করে কোন বিবৃতি বা জবানবন্দী প্রদান করে থাকেন তবে তাকে মৃত্যুকালীন ঘোষণা বলা হয়।
৩২ (১) ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি কোন মামলায় কোন মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উঠে তখন ঐ ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে অথবা ‘যে অবস্থা এবং পরিস্থিতিতে তার মৃত্যু ঘটেছে সে সম্পর্কে যদি বিবৃতি প্রদান করে থাকে, তবে এরূপ বিবৃতি প্রদানের সময় বিবৃতি দানকারীর মৃত্যুর আশংকা উপস্থিত থাকুক বা না থাকুক এবং যে মামলায় তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন উঠে তার প্রকৃতি যাই থাকুক না কেন, উক্ত বিবৃতি প্রাসঙ্গিক।
এরূপ ঘোষণা লিখিত হতে পারে বা মৌখিক হতে পারে কিংবা ভাব ভঙ্গির মাধ্যমে প্রকাশিত হতে পারে। ইহা ম্যাজিস্ট্রেট বা কোন বিশেষ ব্যক্তির নিকট ঘোষণা করতে হবে তার কোন বাধ্যবাধকতা বা বিধি-বিধান নেই। ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ অফিসার বা সাধারণ নাগরিকের নিকট এরূপ ঘোষণা বা বিবৃতি প্রদান করা যায়।
সাক্ষ্য আইনের ৩৩ ধারায় পূর্ববর্তী কোন মামলায় প্রদত্ত কোন সাক্ষীর প্রদত্ত বিবৃতি পরবর্তী মামলায় গ্রহণযোগ্য ও প্রাসঙ্গিক করা হয়েছে। যখন কোন সাক্ষী মৃত অথবা নিখোঁজ বা সাক্ষ্য দিতে অক্ষম বা বিরুদ্ধপক্ষ কর্তৃক প্রতিরুদ্ধ, তখন মামলার বিচার্য বিষয় প্রমাণের জন্য আলোচ্য ধারা মতে, শর্তসাপেক্ষে গ্রহণীয়।
শর্তগুলো নিম্নরূপ-
(ক) পূর্ববর্তী মামলাটি বর্তমান মামলার পক্ষদ্বয়ের মধ্যেই বা তাদের প্রতিনিধিদের মধ্যে হয়েছিল;
(খ) পূর্ববর্তী মামলায় সাক্ষীকে জেরা করার সুযোগ বিরুদ্ধপক্ষের ছিল;
(গ) পূর্ববর্তী মামলায় বিচার্য বিষয় পরবর্তী মামলার বিচার্য বিষয়ের অনুরূপ ছিল।
সাক্ষীকে হাজির করতে অযৌক্তিক দেরী ও অর্থ ব্যয় হবে বলে আদালতের নিকট প্রতীয়মান হলেও উপরিউক্ত শর্ত সাপেক্ষে পূর্ববর্তী মামলার সাক্ষীর প্রদত্ত সাক্ষ্য পরবর্তী মামলায় গ্রহণীয় হবে।
এ প্রসঙ্গে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলার সিদ্ধান্ত নিম্নরূপ
61 DLR(2009) 54 Shahabuddin Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “In the absence of a medical certification that the injured was in a fit state of mind at the time of making the declaration, it would be very much risky to accept the subjective satisfaction of a Magistrate who opined that the injured was in a fit state of mind at the time of making declaration.”
54 DLR(2006)545 The State Vs. Shahidul Islam@Shahid & Oth. মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “Conspiracy is a secretive activity and it can hardly be seen. It may be perceived and may also be inferred from the circumstances of a particular case.”
16 DLR 485 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “কোন জখমকৃত লোক বিশ্বাস করেন যে, তিনি অতি শীঘ্র মারা যাবেন এবং এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করিয়া ম্যাজিষ্ট্রেট তাহার বিবৃতি রেকর্ড করেন কিন্তু জখমকৃত লোক বাঁচিয়া গেলেন। এইক্ষেত্রে উক্ত ম্যাজিষ্ট্রেটকে সাক্ষী হিসাবে হাজির হইতে হইবে। কাজেই তিনি অপরাধীর বিচার করিতে পারেন না।”
সুতরাং বলা যায় যে, আদালতে যে ঘটনার বিচার হচ্ছে, সে সম্পর্কে সাক্ষীকে যেসব বিবৃতি দেয়ার জন্য আদালত অনুমতি দেন বা বিচারের জন্য তার যেসব বিবৃতি আদালতের প্রয়োজন হয়, এসব বিবৃতিকে বলা হয় মৌখিক সাক্ষ্য।
লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।
তথ্য কণিকাঃ আইন শব্দসমূহ-এডভোকেট মোঃ নাসির উদ্দিন, সাক্ষ্য আইনের ভাষ্য- গাজী মোঃ শামসুর রহমান, উইকিপিডিয়া, jjdn, দন্ডবিধি- বাসুদেব গাংগুলি, উকিপিডিয়া, সাক্ষ্য আইন- বাসুদেব গাংগুলি, সাক্ষ্য আইন- মোঃ জহিরুল হক, ফৌজদারী কার্যবিধি-জহিরুল হক, Section Wise 100 years Reference on Crpc, Section Wise 100 years Reference on Penal Code- Md. Abul Kalam Azad। Section Wise 100 years Reference Evidence Act- Mohammed Safiqur Rahman.