যুগোপযোগীকরণের উদ্দেশ্যে বর্তমান সাক্ষ্য আইনের অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ অংশগুলো চিহ্নিত করেছে আইন কমিশন। একই সঙ্গে নতুন আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি প্রাথমিক খসড়াও প্রস্তুত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে খসড়ার একটি কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা, উচ্চ আদালতের সাবেক বিচারপতিগণ, জেলা জজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন অংশীজনের মতামত আহ্বান করা হয়। এদের মধ্যে অনেকেই তাদের মতামত দেন। তা পর্যালোচনা করেই এই খসড়া করা হয়েছে।
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের কমিশন এই খসড়া প্রস্তুত করেছেন। কমিশনের অপর দুই সদস্য হলেন, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর।
প্রস্তাবিত সাক্ষ্য আইনের খসড়ায় দোষ স্বীকারোক্তির সুস্পষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া দলিল বলতে অডিও, ভিডিও, ডিজিটাল নথিসমূহ, যে কোনো ধরনের ডিজিটাল উপাত্ত, কম্পিউটার কার্যক্রম, শব্দ বা চিত্র ধারণকারী যে কোনো ধরনের ডিস্ক বা টেপ ও অপর যে কোনো প্রকার উপাত্ত ধারক, ডিজিটাল স্বাক্ষর, সার্টিফিকেট ও ডিজিটাল মাধ্যমে কৃত যোগাযোগকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত খসড়ায় মৃত্যুকালীন ঘোষণার বিধানটি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি তার আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কা করে এবং উক্ত আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কা হতেই যদি তিনি বক্তব্যটি প্রদান করেন তাহলে যে কার্যধারায় তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন উঠে তার প্রকৃতি যেমনই হোক না কেন, সে বক্তব্যসমূহ প্রাসঙ্গিক।
বিদ্যমান সাক্ষ্য আইনকে বদলে নতুন আইনের খসড়া সম্পর্কে কমিশন বলছে, প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ও বাংলাদেশের বর্তমানে প্রচলিত সাক্ষ্য আইন ও বিদ্যমান বিচারব্যবস্থা বিশদ পর্যালোচনা করে আইন কমিশন নিম্নোক্ত খসড়া প্রস্তুত করেছে। প্রস্তাবিত সাক্ষ্য আইন প্রণয়ন করা হলে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাসহ সামগ্রিক বিচার কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়নের ক্ষেত্রে আইনটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে।
খসড়া প্রস্তুতের রিপোর্টে বলা হয়েছে, অভিযুক্তের সাংবিধানিক ও প্রচলিত অন্যান্য আইনে স্বীকৃত অধিকার রক্ষা করে আইনানুগভাবে আদালতের সম্মুখে সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা প্রয়োজন। পক্ষগণ কর্তৃক যথেচ্ছা অপ্রাসঙ্গিক সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন রোধ এবং কেবল প্রাসঙ্গিক বিষয়সমূহের সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিতকল্পে সাক্ষ্য আইনের গুরুত্ব অপরিসীম। একই ধরনের মামলায় বিভিন্ন আদালত যাতে বিভিন্ন রকম সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ না করেন তাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
আবার, পরিস্থিতি বিবেচনায়, কতিপয় সাক্ষ্যগ্রহণ বা বর্জন বিষয়ে আদালতের সু-বিবেচনামূলক ক্ষমতার প্রয়োজন। অপ্রাসঙ্গিক ও পক্ষপাতমূলক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যেন কোনো ব্যক্তি তাহার আইনি অধিকার বঞ্চিত না হয় বা কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির সাজা না হয় তা নিশ্চিতকল্পে আদালতে সঠিকভাবে সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ ও ব্যবহার সম্পর্কে যুগোপযোগী সাক্ষ্য আইন আবশ্যক। সর্বোপরি, একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য আইনানুগ পদ্ধতিতে সাক্ষ্য উপস্থাপন ও বিচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা নিশ্চিতকল্পে সাক্ষ্য আইনের তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
প্রসঙ্গত বিদ্যমান সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হয়। ব্রিটিশ আমলে প্রণয়ন পরবর্তী এই আইনটি ভারতীয় সাক্ষ্য আইন নামে অভিহিত হয়। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর ভারতীয় শব্দটি সাক্ষ্য আইন থেকে বিলুপ্ত করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনটি বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় অন্যতম পদ্ধতিগত আইন হিসেবে বিভিন্ন বিচার আদালতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
যুগ ও সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধ ও সামাজিক বিরোধের ধরন ও প্রকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের বিরোধ ও অপরাধের বিস্তৃতি লাভ করছে। তাই উক্ত পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি রেখে বিদ্যমান সাক্ষ্য আইনসহ অন্য আইনগুলোকে আরো যুগোপযোগী করা প্রয়োজন, যাতে বর্তমান সময়ে উদ্ভূত বিরোধ ও অপরাধের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
কমিশন বলছে, ব্রিটিশ ঔপনেবেশিক শাসনামলে বর্তমান সাক্ষ্য আইনটি ইংরেজিতে প্রণীত হয়ে অদ্যবধি বহাল থাকায় বেশির ভাগ সময়েই তা বিচারপ্রার্থী জনগণের বোধগম্য হয় না। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। ফলে, বাংলা ভাষায় আইন প্রণয়নের গুরুত্ব কোনো ক্রমেই উপেক্ষা করা যায় না।
তাছাড়া, ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭’ অনুসারে বাংলা ভাষায় আইন প্রণয়ন করার আইনগত বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। বাংলা ভাষায় নতুন সাক্ষ্য আইন প্রণয়ন করা হলে সেক্ষেত্রে ইহা সহজবোধ্য ও ব্যবহার উপযোগী হওয়ার পাশাপাশি সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহারের পথ সুগম করবে।
বর্ণিত প্রেক্ষাপটে, আইন কমিশন দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির সঙ্গে সংগতি রেখে প্রচলিত সাক্ষ্য আইনটি প্রয়োজনীয় পরিমার্জনের মাধ্যমে নতুন করে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ভাষায় প্রণয়ন ও প্রবর্তনে সুপারিশ প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।