দীপজয় বড়ুয়া: ”জব্দ তালিকা” বা SEIZURE LIST অর্থ হল ফৌঃকাঃ 1898 আইনের 103(2) ধারা এবং পিআরবি 280, 465 বিধির আলোকে কোন সন্দেহভাজন জিনিস, চোরাইমাল, বেওয়ারিশ সম্পত্তি, মামলার আলামত ইত্যাদি উদ্ধারের জন্য জব্দ করে আদালতে প্রেরণের জন্য তদন্তকারী অফিসার কর্তৃক ঘটনাস্থলে গিয়ে মামলায় বর্ণিত সংঘটিত অপরাধের আলামত বা প্রমাণ ‘আটক/উদ্ধার/জব্দ’- এর যে তালিকা প্রস্তুত করেন তাকে জব্দ তালিকা বলে।
ফৌজদারী কার্যবিধি ১০৩ ধারা এবং পিআরবি ২৮০ নিয়মানুযায়ী – কোন সন্দেহভাজন জিনিস, চোরাইমাল,বেওয়ারিশ সম্পত্তি, মামলার আলামত ইত্যাদি উদ্ধারের জন্য জব্দ করে আদালতে প্রেরনের জন্য তদন্তকারী অফিসার কর্তৃক ঘটনাস্থলে গিয়ে বিপি নং-৪৪ বাংলাদেশ ফরম নং-৫২৭৬ এর উপর সাক্ষীদের স্বাক্ষর নিয়ে এবং নিজে স্বাক্ষর করে ০৩ কপি জব্দ তালিকা করা । সাক্ষ্য আইনের ০৯ এবং ৩৫ ধারানুযায়ী জব্দ তালিকা আদালতে অপ্রাসঙ্গিক।
উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলার সিদ্ধান্তে জব্দ তালিকার গুরুত্ব
ক) 45 DLR(1993)521 Shubod Ranjan Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, অস্ত্র ও অন্যান্য দ্রব্যাদি উদ্ধারের মামলায় প্রায় ঘটনাস্থলের আশেপাশের লোকদের সাক্ষী মানা হয় না। এতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৩ ধারার বিধান স্পষ্টত লঙ্ঘন করা হয়। আইনের বিধান অনুসারে এই ১০৩ ধারার বিধানটি নাগরিকদের হয়রানির হাত হতে পরিত্রানের রক্ষাকবচ। কাজেই ভিন্ন এলাকার লোকদের সাক্ষী মানা হলে মামলার সত্যতা সন্দেহজনক হয়ে পড়ে এবং মিথ্যায় পর্যবসিত হতে পারে। এ ক্রটি অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
খ) 57 DLR(2005) 615(620, Judgement para 23); 14 BLT(HCD) 2006 page 141 Ashadul Hossain Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ অভিমত দিয়েছেন যে, ওই মামলায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৩ ধারার বিধান পালন করা আবশ্যক ছিল না, কারণ আসামি যখন খুব দ্রুত বিছানার চাদরের নিচে অস্ত্র ও গুলি লুকিয়ে রেখে পালাতে চেষ্টা করছিল তখন অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয় বিধায় নিয়মমতো বাড়িতে তল্লাশ চালানোর অবকাশ ছিল না।
গ) CR 1996(3) SC Sahib Shing Vs The Punjab State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, জব্দকারী কর্মকর্তার কাজের স্বচ্ছতা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা দেখানোর জন্যই তল্লাশ কাজ শুরু করার পূর্বেই তাকে স্থানীয় কতিপয় নিরপেক্ষ ও সম্মানিত ব্যক্তিদের তল্লাশ কাজে সাক্ষী হওয়ার জন্যআহ্বান জানাতে হবে। কোনো মামলায় এমন হতে পারে যে, এরূপ ব্যক্তি পাওয়া যাচ্ছে না, বা যদিও পাওয়া যায়, তথাপি তারা তল্লাশ কাজে সাক্ষী হতে চায় না। এমনও হতে পারে যে, তল্লাশ কাজে সাক্ষী হিসেবে যোগদান করে পরে তিনি বৈরী মনোভাবাপন্ন হয়েছেন। এরূপ যেকোনো অবস্থায় তল্লাশ প্রমাণের জন্য কোনো নিরপেক্ষ ও সম্মানিত সাক্ষী পরীক্ষা করা হয়নি, কেবলমাত্র এই অজুহাতে তল্লাশকারী পুলিশ কর্মকর্তার সাক্ষ্য অবিশ্বাস করা যাবে না।
কিন্তু যদি দেখা যায় যে, তল্লাশকারী পুলিশ কর্মকর্তা স্থানীয় ব্যক্তিদের তার তল্লাশ কাজে সাক্ষী হিসেবে যোগদান করার জন্য আহ্বান করার কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেননি, তাহলে তার সাক্ষ্য গৃহীত হওয়ার বিষয়টি ক্ষুণ্ণ না হলেও তার সাক্ষ্যমূল্য ক্ষুণ্ণ হবে।
এছাড়াও মোঃ মাইনুল হক বনাম আসাম রাজ্য, ২০১২ সিআরএলজে ৩৯৯৬ (গৌহাটি) দ্রষ্টব্য। সুতরাং তল্লাশকারী কর্মকর্তার উদ্যোগ ও তৎপরতা যথার্থ হওয়া আবশ্যক।
ঘ) যেসব মামলায় বহু দ্রব্য উদ্ধার করা হয় (যেমন চোরাচালানের মামলা, ফেনসিডিলের মামলা), ওই সকল দ্রব্যের গায়ে লেবেল এঁটে জব্দকারী কর্মকর্তা লেবেলে স্বাক্ষর করবেন। (পিআরবি এর ২৮০ প্রবিধান দ্রষ্টব্য)। এ নিয়ম পালন করা হয় না বললেই চলে। ফলশ্রুতিতে এক মামলার জব্দকৃত দ্রব্যাদি অন্য মামলায় ব্যবহার করা হয়/হচ্ছে বলে প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায়। কাজেই এ নিয়ম পালন করতেই হবে। এক্ষেত্রে গাফিলতি করার অবকাশ নেই।
ঙ) দ্রব্যাদি উদ্ধারের মামলায় যে জিডি/সিসি এর মাধ্যমে জব্দকারী কর্মকর্তা থানা হতে বের হয়ে ঘটনাস্থলে মালামাল সিজারলিষ্টের মাধ্যমে জব্দ করেন, ওই সিজারলিষ্টে উক্ত জিডি/সিসি সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়। বেশ কিছু মামলায় এটা পালন করা হয়নি।
জব্দ তালিকায় যে সকল বিষয় উল্লেখ করা হয় তা নিম্নরূপ
বি পি ফরম নং-৪৪
সুত্রঃ …………থানার মামলা/সাধারণ ডায়রী নং-৪৫৪ । তাং- ../../…..
একটি জব্দ তালিকায় যে সকল বিষয়
উল্লেখ থাকে নিম্নে দেওয়া
হলঃ-
১। সূত্র।
২। জব্দ করার তারিখ ও সময়।
৩। জব্দ করার স্থানের বিবরণ।
৪। সাক্ষীদের নাম ও ঠিকানা।
৫। জব্দকৃত মালামালের বিবরণ।
৬। সাক্ষীদের স্বাক্ষর।
৭। যার নিকট হতে মালামাল জব্দ করা হয়েছে তার নাম, ঠিকানা ও স্বাক্ষর।
৮। জব্দ তালিকা প্রস্তুতকারী অফিসারের নাম,পদবী ও ঠিকানা।
সুতরাং বলা যায় যে, ফৌঃ কাঃ 1898 আইনের 103(2)ধারা এবং পিআরবি 280, 465 বিধির আলোকে মামলায় বর্ণিত সংঘটিত অপরাধের আলামত বা প্রমাণ ‘আটক/উদ্ধার/জব্দ- এর যে তালিকা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তৈরী করেন, তাই ”জব্দ তালিকা”।
লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।
তথ্য কণিকা: ফৌজদারী কার্যবিধি-জহিরুল হক, ফৌজদারী কার্যবিধি- মুহাম্মদ সাইফুল আলম, ফৌজদারী কার্যবিধির ভাষ্য-গাজী শামসুর রহমান, ফৌজদারী মামলার বিচার এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়- কে.এম.রাশেদুজ্জামান রাজা, শতাধিক বছরের ক্রিমিনাল কেস রেফারেন্স-এডভোকেট কামালউদ্দিন, ক্রিমিনাল কেস রেফারেন্স- জীবরুল হাসান, ফৌজদারী কার্যবিধি প্রাকটিস ও পদ্ধতি-মোঃ মোসলেম উদ্দিন খান, তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং ম্যাজিষ্ট্রেটের করণীয়- বিচারপতি মোঃ আজিজুল হক, Section Wise 100 years Reference on Crpc, Section Wise 100 years Reference on Penal Code- Md. Abul Kalam Azad।