সিরাজ প্রামানিক: জমি—জমা নিয়ে কেউ অপরাধ করলে, প্রতারণা করলে, জালিয়াতি করলে, জোর জুলুম করলে, ফাঁকি দিলে, অবৈধভাবে উচ্ছেদ করলে কিংবা জবর দখল করলে ৭ বছরের জেল হতে পারে। দেওয়ানী আদালতে মামলা করে বছরের পর বছর রায়ের জন্য আর অপেক্ষা করতে হবে না। ভূমি অপরাধ প্রতিকার আইন—২০২৩ এ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফৌজদারী আদালতে নালিশী মামলা করে সহজে ভূমি খেকোদের দমন করা সম্ভব।
জাল দলিল তৈরি করে অন্যের সম্পত্তি নিজের বলে দাবি ও প্রচারণার অভিযোগে নতুন আইনে প্রথম মামলা হয় ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর। ঢাকার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মোস্তাফিজুর রহমানের আদালতে সালমা বেগম নামের এক নারী বাদী হয়ে এ মামলা করেন। এতে মো. বশির উদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করে রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ দেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, সালমা বেগম ও তার মেয়ে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের এলাকার বাসীন্দা। আসামি বশির উদ্দিন তাদের দুই মা মেয়ের সম্পত্তির মিথ্যা জাল দলিল তৈরি করে নিজের নামে মালিকানা দাবি ও প্রচার করে নামজারি করেন। পরবর্তীতে ওই সম্পত্তি জোর করে দখলের চেষ্টা করলে তারা চিৎকার কান্না কাটি করেন। এ সময় আশপাশের লোকজন উপস্থিত হলে আসামী চলে যান। তবে যাওয়ার সময় তাদেরকে প্রাণনাশের হুমকি দেন। নতুন আইনে ভূমি প্রতারণা, জালিয়াতি, অবৈধ দখলের মামলা ১৮০ দিন বা ৬ মাসের মধ্যে বিচার শেষ করার বিধান রাখা হয়েছে। পাশাপাশি ভূমি প্রতারণা, জালিয়াতি, অবৈধ দখলের মতো ১২টি অপরাধ চিহ্নিত করে সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের বিধান রাখা হয়েছে।
ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩ এর ৪(১) (ক থেকে ছ) ধারায় বলা আছে, অন্যের মালিকানাধীন জমি নিজের বলে দাবী বা প্রচার করলে, তথ্য গোপন করে জমি অন্যের নিকট বিক্রয় করলে, নিজের মালিকানার চেয়ে অতিরিক্ত জমি কারও নিকট সমর্পণ করলে, মিথ্যা পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তির স্থলে অন্য ব্যক্তি সাজিয়ে জমি হস্তান্তর করলে, মিথ্যা বিবরণ সম্বলিত কোনো দলিল স্বাক্ষর বা সম্পাদন করলে, কর্তৃপক্ষের নিকট কোন মিথ্যা বা অসত্য তথ্য প্রদান করলে সে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ অনধিক সাত বছর পর্যন্ত কারাদন্ড ও অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে।
৫(১) ক থেকে ঙ) ধারা র্পন্ত বলা আছে যে, কোনো ব্যক্তির ক্ষতি বা অনিষ্ট সাধন করা বা কোনো দাবি বা অধিকার সমর্থন করা অথবা কোনো ব্যক্তিকে কোনো সম্পত্তি পরিত্যাগ বা চুক্তি সম্পাদন করিতে বাধ্য করা অথবা প্রতারণা করা যেতে পারে এইরূপ অভিপ্রায়ে কোনো মিথ্যা দলিল বা কোনো মিথ্যা দলিলের অংশবিশেষ প্রস্তুতকরণ করলে, কোনো দলিল বা তার অংশবিশেষ এইরূপ কোনো ব্যক্তি কর্তৃক স্বাক্ষরিত, সিলমোহরকৃত বা সম্পাদিত বলে বিশ্বাস করার অভিপ্রায়ে প্রস্তুত, স্বাক্ষর, সিলমোহর সম্পাদন করলে, কোনো দলিল সম্পাদিত হওয়ার পর আইনানুগ কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে, অসাধু বা প্রতারণামূলকভাবে, উহার কোনো অংশ কর্তন করা বা অন্য কোনোভাবে উহার কোনো গুরুত্বপূর্ণ অংশের পরিবর্তন করলে; সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে কোনো মিথ্যা দলিল প্রস্তুতকরণ করলে, অসাধু বা প্রতারণামূলকভাবে কোনো ব্যক্তিকে কোনো দলিল স্বাক্ষর, সিলমোহর, সম্পাদনা বা পরিবর্তন করিতে বাধ্য করলে অনধিক ৭ (সাত) বৎসর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।
এ মামলা করলে-
১. আসামীদের বিরুদ্ধে আদালত স্বাক্ষরিত সমন ইস্যু করা হয়। যেখানে আদালতে হাজির হবার জন্য একটি নির্দিষ্ট তারিখ থাকে। তার পূর্বে মামলাটি আদালত তদন্ত দিতে পারেন কিংবা প্রাথমিকভাবে সত্য প্রমাণিত না হলে মামলাটি খারিজ করে দিতে পারবেন।
২. এরপর সমনে উল্লেখিত তারিখে আসামী হাজির না হলে আদালত তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করেন।
৩. ওয়ারেন্ট এ উল্লেখিত তারিখে আসামীকে হাজির করা না গেলে বা আসামী পলাতক থাকলে আদালত তার বিরুদ্ধে WP & A (Warrant of Proclamation and Attachment) ইস্যু করেন। এটি ‘হুলিয়া’ বলে পরিচিত।
৪. WP & A এ তে উল্লেখিত তারিখে আসামীকে হাজির করা না গেলে বা আসামী পলাতক থাকলে এবং আদালত তার বিরুদ্ধে দুটি বহুল প্রচলিত বাংলা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রদানের আদেশ দেন।
৫. পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রদানের পরও উল্লেখিত তারিখে আসামী হাজির না হলে বা আসামী পলাতক থাকলে তার অনুপস্থিতিতে বিচার শুরু হয়। একে আইনের ভাষায় (Trial In Absentia) বলে।
৬. উপরোক্ত কোন প্রক্রিয়ায় বা স্বেচ্ছায় অভিযুক্ত ব্যক্তি হাজির হলে আদালত তাদের উপর আনীত অভিযোগ তাদেরকে পড়ে শোনাবেন। তাদের বিরূদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করলে আদালত তার জন্য তাদের কে শাস্তি প্রদান করবেন। অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার করলে উহার সত্যতা নিরূপনের জন্য সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহনের নিমিত্তে সাক্ষীদের প্রতি সমন এবং ক্ষেত্র বিশেষে অনান্য প্রসেস যেমন :WW বা witness warrant এবং NWW বা Non Bailable Witness Warrant ইস্যু করা হয়। তবে চার্জ শুনানীতে যদি আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয় যে, আসামীদের বিরূদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা নেই তাহলে বিচারে না গিয়ে আসামী/আসামীদের কে অব্যাহতি দিতে পারেন।
৭. এই পর্যায়ে ফরিয়াদী পক্ষের আইনজীবী ফরিয়াদী সহ তার মনোনীত সাক্ষীদের জবানবন্দী গ্রহন করেন এবং আসামী পক্ষ তাদের জেরা করেন।
৮. সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহন সমাপ্ত হলে আদালত আসামী পরীক্ষা ও উভয় পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শ্রবণ পূর্বক রায় ঘোষনার জন্য তারিখ ঘোষনা করেন।
৯. সাক্ষীদের সাক্ষ্য, নথিস্থ কাগজাত ও অনান্য পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিশ্লেষন করে আদালতের নিকট সন্দেহাতীত ভাবে আসামীদেরে বিরূদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনানুসারে শাস্তি প্রদান করেন কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত না হলে খালাস প্রদান করেন।
১০. কোন পক্ষ আদালতের প্রদত্ত রায়ে সন্তুষ্ট না হলে এখতিয়ার সম্পন্ন উচ্চ আদালতে আপীল করতে পারেন। এভাবে ফৌজদারী কার্যবিধির পদ্ধতি অনুযায়ী মামলার কার্যক্রম শেষ হয়।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, আইনের শিক্ষক ও আইন গবেষক। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com