সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন ঘিরে মারামারি, এক প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করতে নির্বাচন কমিটিকে বাধ্য করা, মামলা, আইনজীবীদের গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে পাঠানোর ঘটনা এখন দেশের সর্বোচ্চ আদালতে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। এই ঘটনায় সর্বশেষ সমিতির সাবেক একজন সম্পাদকের চার দিনের পুলিশি রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এ নিয়ে একজন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলসহ মোট ছয়জনকে রিমান্ডে পাঠানো হলো।
সর্বোচ্চ আদালত অঙ্গনে এমন ঘটনাকে দুঃখজনক ও লজ্জাজনক উল্লেখ করে উদ্বেগ জানিয়েছেন বিশিষ্ট চার আইনজীবী। তাঁরা বলেন, এমন ঘটনা আইনজীবীদের মর্যাদা ধূলিসাৎ করেছে। আইনজীবীরাই যদি মারামারি ও হত্যাচেষ্টার মতো ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়েন; এর থেকে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে?
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিকের মতে, দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়া ও পেশিশক্তির ব্যবহারের প্রতিফলন সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনেও দেখা গেল। এটা দুঃখজনক।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন ঘিরে শুধু এবার নয়, এর আগে দুবারও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। গত নির্বাচনেও (২০২৩-২৪) ভাঙচুর, হট্টগোল ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটেছিল। এর আগে ২০২২ সালেও হট্টগোলের মধ্যে নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়ক পদত্যাগও করেছিলেন। তবে এবারের ঘটনা আগের দুই নির্বাচনের ঘটনাকে ছাড়িয়েছে।
এবারের সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হয় ৬ ও ৭ মার্চ। ভোট গণনা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে হট্টগোল ও মারধরের ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে বেশ কয়েকজন বহিরাগত ব্যক্তিও সমিতি মিলনায়তনে ঢুকে পড়েন। মারধরের শিকার হন নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত উপকমিটির সদস্য ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুর রহমান সিদ্দিকীসহ আরও কয়েকজন আইনজীবী।
পরে এই ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা করেন আহত সাইফুর রহমান সিদ্দিকী। মামলায় তাঁকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে দুই সম্পাদক পদপ্রার্থী নাহিদ সুলতানা যুথী, রুহুল কুদ্দুস কাজলসহ ২০ জনকে আসামি করা হয়। নাহিদ সুলতানা যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামসের (পরশ) স্ত্রী। আর রুহুল কুদ্দুস বিএনপি–সমর্থিত জাতীয়তাবাদী ঐক্য প্যানেল থেকে সম্পাদক পদপ্রার্থী।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, ৮ মার্চ ভোরে মারধরের ঘটনার সময় সম্পাদক পদে নাহিদ সুলতানাকে বিজয়ী ঘোষণা করতে নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত উপকমিটির প্রধানকে বাধ্য করা হয়। মারামারির ঘটনায় করা এই মামলায় যুবলীগের তিনজন পদধারী নেতাকেও আসামি করা হয়।
অবশ্য পরে ভোট গণনা শেষে শনিবার দিবাগত রাত দেড়টায় যে ফলাফল ঘোষণা করা হয়, তাতে সভাপতি পদে বিএনপির এ এম মাহবুব উদ্দিন (খোকন) এবং সম্পাদক পদে আওয়ামী লীগের শাহ মঞ্জুরুল হক নির্বাচিত হয়েছেন। সমিতির ১৪টি পদের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১০টি, বিএনপি পেয়েছে ৪টি।
এর আগে মারধরের ঘটনায় করা মামলায় শনিবার সন্ধ্যায় গ্রেপ্তার করা হয় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুসকে। তাঁকে গতকাল আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তাঁকে চার দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন। একই মামলায় এর আগে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী বশির আহমেদসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে এমন মারামারি ও গ্রেপ্তারের ঘটনা আইনজীবীদের সম্মান ধূলিসাৎ হয়েছে বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। তিনি বলেন, একজন আইনজীবী যদি বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িত হন, সেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। গণমাধ্যমে যা প্রকাশ পেয়েছে, তাতে আইনজীবী সম্পর্কে জনগণের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা জন্ম নিচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বারবার এমন অগ্রহণযোগ্য ঘটনার জন্য আইনজীবী নেতাদের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিকে দায়ী করেন আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না। তিনি বলেন, এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে; তাতে সাধারণ আইনজীবীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তাঁর মতে, লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি যত দিন পরিহার না হবে, তত দিন এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকবে।
এদিকে ভোটে অনিয়মের অভিযোগ তুলে নির্বাচন বাতিল করে আবার নির্বাচনের দাবি করেছেন সদ্য নির্বাচিত সভাপতি এ এম মাহবুব উদ্দিন। গতকাল দুপুরে হাইকোর্ট ভবনের বর্ধিত ভবনের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ দাবি জানান তিনি।
মাহবুব উদ্দিনের এই বক্তব্যকে দলের জন্য ‘স্ট্যান্টবাজি’ বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্যানেল থেকে সদ্য নির্বাচিত সম্পাদক শাহ মঞ্জুরুল হক।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবীদের নির্বাচন ঘিরে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা ‘এক কথায় দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেন সাবেক আইনমন্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শফিক আহমেদ। তিনি বলেন, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এই সমিতির ঐতিহ্য ও সম্মান সমুন্নত রাখার জন্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের এখনই বসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।