ঢাকা শহরের পার্ক ও খেলার মাঠ: কোথায় আছে, কেমন আছে
মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল—গালিব

ঢাকা শহরের পার্ক ও খেলার মাঠ: কোথায় আছে, কেমন আছে

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল—গালিব: দেশের রাজধানী ঢাকা মহানগরী ১ হাজার ৫২৮ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট যেখানে ১৬ মিলিয়ন লোকের আবাসভূমি। প্রাচ্যের ভেনিস হিসেবে খ্যাত এ মহানগরী বর্তমানে বিশ্বের বসবাস অযোগ্য নগরীর পরিচয় গ্রহণ করেছে। অপরিকল্পিতভাবে দ্রুত প্রসারিত মেগাসিটিগুলোর মধ্যে বর্তমানে ঢাকা অন্যতম। অপরিকল্পিত নগরায়ন গ্রাস করছে এ নগরীর পার্ক ও খেলার মাঠের মতো নাগরিক সুবিধাদি।

নগর—পরিকল্পনাবিদদের মতে, একটি আধুনিক শহরে প্রতি আধা বর্গকিলোমিটার এলাকার জন্য একটি করে খেলার মাঠ প্রয়োজন। রাজধানী উন্নয়ন কতৃর্পক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) প্রস্তাবনা অনুসারে, ঢাকাতে প্রতি ১২ হাজার ৫০০ জন মানুষের জন্য ২ একর খেলার মাঠ এবং ১ একর পার্ক থাকা উচিৎ। বর্তমানে জনসংখ্যা বিবেচনায় প্রতি ৩৭৯০০ জন মানুষের জন্য ১ একর খেলার মাঠ বা পার্ক রয়েছে যা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। ঢাকার দুইটি সিটি কর্পোরেশনের আয়তন ৩০৫.৪৭ বর্গকিলোমিটার। আয়তন বিবেচনায় দুই কর্পোরেশনে খেলার মাঠ দরকার অন্তত ৬১০টি, রয়েছে মাত্র ২৩৫টি। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১২৯টি ওয়ার্ড থাকলেও ড্যাপে উল্লেখ রয়েছে যে ৪১টি ওয়ার্ডে কোনো খেলার মাঠ নেই। ঢাকা শহরে যে মাঠগুলো রয়েছে সেগুলোর আয়তন যেমন জনসংখ্যার তুলনায় পর্যাপ্ত নয় তেমনি অধিকাংশ মাঠগুলোতে নেই সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার। ড্যাপ অনুসারে প্রয়োজনের তুলনায় মাঠের জমি আছে মাত্র ২৪ ভাগ এবং পার্কের জমি আছে ১৬ ভাগ।

দেশের জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৫৪টি ওয়ার্ডে পার্ক রয়েছে মাত্র ২৩টি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৭৫টি ওয়ার্ডে পার্ক বা উদ্যান রয়েছে মাত্র ২৭টি। এর মধ্যে ৬টি পার্ক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ইজারা প্রদান করা হয়েছে। ইজারা প্রদানকৃত পার্কসমূহে ইজারা ভঙ্গ করে নির্মাণ করা হয়েছে নানা স্থাপনা। পার্কের জায়গা দখল করে শিশু—কিশোরদের বিনোদনের নামে বসানো হয়েছে বিভিন্ন রাইড যাতে কেবল অর্থের বিনিময়ে প্রবেশাধিকার মেলে নাগরিকদের।

দক্ষিণ সিটি কপোর্রেশন বছরে পাক র্বা উদ্যানের উন্নয়নে ০.৫০ কোটি টাকা এবং খেলার মাঠের উন্নয়নে ৫ কোটি টাকা ব্যয় করে। উত্তর সিটি কপোর্রেশন পার্ক উন্নয়ন ও রক্ষরাবেক্ষণে বছরে ১৫ কোটি টাকা এবং খেলার মাঠ উন্নয়ন ও রক্ষরাবেক্ষণে বছরে ২৫ কোটি টাকা ব্যয় করে। বাজেট থেকেই এটা স্পষ্ট যে সিটি কপোর্রেশন শহরের পার্ক, খেলার মাঠ নিয়ে কতটা সচেতন।

শহরে পর্যাপ্ত পার্ক এবং খেলার মাঠ না থাকায় ঢাকার মোট জনসংখ্যার ২৭.৮২% তরুণ খেলার মাঠের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে শিশু ও তরুণদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব পরছে। পাশাপাশি খেলার মাঠ, পার্ক এবং উন্মুক্তস্থান সংকটে কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির পাচ্ছে। অধিকাংশ শিশুকে বাড়িতেই সময় কাটাতে হচ্ছে; আসক্তি বাড়ছে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের। একইসাথে নাগরিকগণ বঞ্চিত হচ্ছে নির্মল বায়ু সেবন, ব্যায়াম ও হাঁটাচলার অধিকার থেকে। সর্বোপরি গাছপালা—প্রকৃতির সাথে মানুষের সংযোগ স্থাপনের মত জরুরি সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নগরবাসি।

রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করতে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব—বৈচিত্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করার নিমিত্তে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করেছে। পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন সাধনে পার্ক, খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০ এর ৫ ধারা অনুসারে, এই আইনের বিধান অনুযায়ী ব্যতীত, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসাবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণী পরিবর্তন করা যাবে না বা উক্তরূপ জায়গা অন্য কোনভাবে ব্যবহার করা যাবে না বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনভাবে হস্তান্তর করা যাবে না।

স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯—এর তৃতীয় তফসিল ক্রমিক ২৪.৩ এবং ২৪.৫ এ সিটি কর্পোরেশন সর্বসাধারণের সুবিধার্থে প্রয়োজনীয় উদ্যান নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে এবং উন্মুক্ত স্থানের ব্যবস্থা করবে বলে উল্লেখ রয়েছে। জাতীয় শিশুনীতি, ২০১১—এর নীতি ৬.৬.১ এ বলা হয়েছে নগর পরিকল্পনায় আবশ্যিকভাবে শিশুদের জন্য খেলার মাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ২৩ জুলাই, ২০১৯ তারিখে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় কতৃর্ক জারিকৃত পরিপত্র অনুযায়ী মানসম্মত নাগরিক সেবা প্রদানের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে শিশুবান্ধব সেবা প্রদান, শিশুদের জন্য পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ এবং অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) কর্তৃক দায়েরকৃত একটি জনস্বার্থমূলক মামলার (নং ১০৫৩/২০২৪) প্রাথমিক শুনানী শেষে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ বিগত ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ তারিখে ঢাকা মহানগরীতে বিদ্যমান সকল পার্ক ও খেলার মাঠের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত; অনতিবিলম্বে পার্ক ও খেলার মাঠে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং বিদ্যমান পার্ক ও খেলার মাঠে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার নির্দেশ প্রদান করেন। মহামান্য আদালত এ নির্দেশসমূহ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, রাজধানী উন্নয়ন কতৃর্পক্ষের চেয়ারম্যান এবং গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী—এর উপর জারি করেন।

অন্তবর্তীকালীন এ আদেশের পাশাপাশি হাইকোর্ট জনসাধারণের ব্যবহার্য পার্ক ও খেলার মাঠে বাণিজ্যিকীকরণ, অননুমোদিত স্থাপনা নির্মাণ, পার্ক ও খেলার মাঠ বিরুদ্ধ ব্যবহার, শ্রেণি পরিবর্তন এবং দখল সংবিধান ও প্রচলিত আইনের পরিপন্থি হওয়ায় কেন তা বেআইনী, আইনি কতৃর্ত্ববিহীন এবং আইনগতভাবে ভিত্তিহীন ঘোষনা করা হবে না তা জানতে চেয়েছেন আদালত। একইসাথে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) এর প্রস্তাবনা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পার্ক ও খেলার মাঠের ব্যবস্থা করার নির্দেশ কেন প্রদান করা হবে না সেবিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছেন আদালত। সেইসাথে মহানগরীর পার্ক ও খেলার মাঠে বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ, শ্রেণি পরিবর্তন ও বিরুদ্ধ ব্যবহাররোধ এবং বিদ্যমান সকল স্থাপনা উচ্ছেদ করে পার্ক ও খেলার মাঠ পুনরুদ্ধারের নির্দেশ কেন প্রদান করা হবে না তাও জানতে চেয়েছেন মহামান্য আদালত।

অন্য একটি জনস্বার্থমূলক (নং ২০৩২/২০২৩) মামলা মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৪৫ নং ওয়ার্ডের অন্তভুর্ক্ত ঐতিহাসিক ধূপখোলা খেলার মাঠে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক মার্কেট ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ সংক্রান্ত সকল কার্যক্রমের উপর স্থিতাবস্থা আরোপ করেছেন। একইসাথে মহামান্য আদালত ধূপখোলা মাঠ বিরুদ্ধ সকল ব্যবহার থেকে বিরত থাকতেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনকে নির্দেশ প্রদান করেছেন। অপর একটি জনস্বার্থমূলক (নং— ১০৯৮৫/২০১৪) মামলায় ২ ডিসেম্বর, ২০১৫ ঢাকার কাওরান বাজারের পান্থকুঞ্জ পার্কে সকল স্থাপনা নির্মাণে নিষেধজ্ঞা প্রদান এবং সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) স্থাপন অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করেছে আদালত।

জনস্বার্থমূলক মামলা (নং ৩৪৭৫/২০০৩) মামলার চূড়ান্ত শুনানী শেষে মহামান্য আদালত বিগত ১৫ মার্চ, ২০১১ তারিখে ঢাকার খেলার মাঠ ও পার্ক সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের নির্দেশ প্রদান করেন। একইসাথে এসব খেলার মাঠে এবং পার্কে স্থাপিত স্থাপনা অপসারণের এবং মামলাভুক্ত খেলার মাঠ ও পার্কের সীমানা নির্ধারণের নির্দেশ প্রদান করেন।

উল্লেখিত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, শহরের পার্ক ও খেলার মাঠ রক্ষায় এবং উন্নয়নে রয়েছে আইন ও আদালতের নির্দেশনা। পরিতাপের বিষয় হলো তবুও রক্ষা পাচ্ছে না পার্ক ও খেলার মাঠ। আইনের সঠিক প্রয়োগ ও আদালতের নির্দেশনা প্রতিপালন, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ, উন্নয়ন এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের পূর্বে পরিবেশ ও প্রতিবেশ কে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান, পার্ক ও খেলার মাঠে বাণিজ্যিক স্থপনা নির্মাণ বন্ধকরণ, ড্যাপের দ্রুত বাস্তবায়ন, বাস্তবতার নিরিখে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক স্বদিচ্ছাই পারে নাগরিকদের জন্য বিশুদ্ধ বাতাস এবং সুস্থ বিনোদনের অন্যতম উৎস পার্ক ও খেলার মাঠ রক্ষা করতে।

লেখক: এডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা এবং আইনজীবী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি।