নিরাপরাধ মা ও শিশুর ২২ ঘণ্টা হাজতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন চায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। ‘শিশুসন্তানসহ নির্দোষ নারী ২২ ঘণ্টা থানা হাজতে আটক, অভিযুক্ত এসআইয়ের শাস্তি দাবি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত অভিযোগ গ্রহণ করে।
এ বিষয়ে স্বতঃপ্রণোদিত অভিযোগে (সুয়োমটো) উল্লেখ রয়েছে, পুলিশের ভুলে নিরাপরাধ মা ও শিশুর ২২ ঘণ্টা হাজতবাস ও মামলায় অন্তর্ভুক্তির অভিযোগটি নিন্দনীয়। মা ও শিশুর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে মর্মে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান। এ অবস্থায় বর্ণিত ঘটনা তদন্ত করে দায় নিরূপণপূর্বক একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন আগামী ৩০ জুলাই মধ্যে কমিশনে পাঠানোর জন্য সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, প্রতারণার অভিযোগে আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা ছিল এক নারীর বিরুদ্ধে। পুলিশ তার বদলে নির্দোষ এক নারীকে ধরে কোলের শিশুসহ ২২ ঘণ্টা থানা হাজতে আটক রেখে আদালতে পাঠায়। ওই নারী আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার শাস্তির দাবি জানান। ঘটনাটি রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার। কাউনিয়া থানা-পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ পাওয়া যায়।
পরিচয় বিভ্রাট
কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, প্রতারণার অভিযোগে ওই আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা ছিল মমতাজ বেগম নামের এক নারীর নামে। পরোয়ানায় তার স্বামীর নাম রফিকুল ইসলাম, সাং কুর্শা, ডাকঘর, বড়ুয়াহাট, থানা কাউনিয়া লেখা রয়েছে। কিন্তু পুলিশ ওই মমতাজ বেগমের বদলে যাকে ধরেছিল, তার নাম শারমিন আক্তার, স্বামীর নাম সেকেন্দার আলী, ইউনিয়ন কুর্শা, গ্রাম, চান্দঘাট, উপজেলা, কাউনিয়া। শারমিনের ডাকনাম মমতাজ।
আদালতে দায়ের করা মামলার আরজি সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি সংস্থা টিএমএসএসের রংপুরের পীরগাছা উপজেলার অন্নদানগর শাখা থেকে রফিকুলের স্ত্রী মমতাজ বেগম ২০২১ সালের ৭ মার্চ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ঋণ নেন। সুদে-আসলে তা দাঁড়ায় ১ লাখ ৪২ হাজার ৯৫০ টাকায়। এ টাকা পরিশোধ না করায় প্রতারণার অভিযোগে মমতাজের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ২১ এপ্রিল রংপুরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত পীরগাছায় টিএমএসএসের কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান মামলা করেন।
এ মামলায় গত বছরের ২ মে ওই আদালত থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। আদালতের ওই পরোয়ানামূলে ২২ জুন বিকেল ৪টার দিকে কাউনিয়া থানার এসআই রবিউল ইসলাম প্রকৃত আসামি মমতাজ বেগমকে না ধরে শারমিন আক্তার ওরফে মমতাজ নামের ওই নির্দোষ নারীকে ধরে তার কোলের শিশুসহ থানা-হাজতে আটকে রাখেন।
২৩ জুন বিকেলে থানা থেকে শারমিনকে আদালতে পাঠানো হলে আদালত তাকে জামিন দেন।
জোর করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ
শারমিন আক্তার বলেন, তার স্বামী সেকেন্দার আলী ঢাকায় বেসরকারি চাকরি করেন। গত কোরবানির ঈদে বাড়ি এসে সেকেন্দার আলী ২২ জুন বিকেলে নিজ কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছিলেন।
এসময় স্থানীয় বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিতে স্বামীর সঙ্গে স্ত্রী শারমিন আক্তারও সেখানে যান। বিকেল ৪টার দিকে ওই বাসস্ট্যান্ডে স্বামীসহ তাকে সাদা পোশাকে কয়েকজন ঘিরে ধরে নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করেন।
তারা স্বামী-স্ত্রী নিজেদের পরিচয় দেন। পুলিশের এসআই রবিউল ইসলাম এ সময়ে হাতে থাকা কাগজে নামের ভিন্নতা পেয়ে শারমিনকে ধমকান এবং বলেন, ‘তোমার স্বামীর নাম সেকেন্দার নয়, রফিকুল ইসলাম।’
এর পরে স্বামীকে রেখে জোর করে শারমিনকে পুলিশের গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যান ওই এসআই।
শারমিন আক্তারের অভিযোগ, ‘আমার ডাকনাম মমতাজ বেগম। কিন্তু আমার স্বামী, বাবার নাম ও ঠিকানা ভিন্ন থাকার পরও পুলিশ দুই বছরের শিশুসন্তানসহ আমাকে অন্যায়ভাবে থানা-হাজতে আটকে রাখে।’
তিনি আরও বলেন, এসআই রবিউল ইসলাম তাকে (শারমিন) শিখিয়ে দেন, আদালতে গিয়ে স্বামীর নাম সেকেন্দার আলীর বদলে রফিকুল ইসলাম বললে দ্রুত জামিন পাবেন। অন্যথায় জামিন হবে না। এ কারণে আদালতে ওই পরিচয়েই জামিন পেয়েছেন তিনি।
শারমিন আক্তার অভিযোগ করে বলেন, ‘পুলিশকে হাজারবার বলেছি, আমার নাম-ঠিকানা যাচাই করে দেখেন। আমি কারও কাছে কখনো টাকা নিইনি। আমার নামে কোনো মামলা নেই। কিন্তু পুলিশ আমার কিংবা আমার পরিবারের সদস্যদের কারও কোনো কথা শোনেনি। থানায় নতুন লোকজন দেখে ভয়ে আমার বুকের দুধ খাওয়া শিশুটি অনেক কান্নাকাটি করে। আমিও অনেক ভয় পেয়েছি। থানা-হাজতে সারারাত ঘুমোতে পারিনি। গরমে খুব কষ্টে রাত কেটেছে। বিনা দোষে শিশুসন্তানসহ আমাকে ২২ ঘণ্টা কেন থানা-হাজতে আটকে রাখা হলো? আমি এর কঠিন বিচার চাই।’
সেই এসআই প্রত্যাহার
নামের মিল থাকায় নির্দোষ নারীকে রাতভর থানায় শিশুসন্তানসহ আটকে রেখে পরদিন আদালতে পাঠানোর ঘটনায় অভিযুক্ত এসআই রবিউল ইসলামকে রংপুর পুলিশ লাইনসে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সোমাবর (১ জুলাই) রাতে এই প্রত্যাহার আদেশ দেওয়া হয়।
এর আগে গত রোববার (৩০ জুন) সন্ধ্যায় জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মোছা. সুলতানা রাজিয়াকে ঘটনা অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।