বাংলাদেশে দ্রুত গতিতে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বয়স্ক লোকের অবসর জীবন নিরুদ্বেগ, স্বচ্ছল ও শান্তিময় করার জন্য জনস্বার্থে পেনশন ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি যা অবহেলিত একটি বিষয়।
ইংরেজি পেনশন শব্দের সাধারণ অর্থ অবসর ভাতা বা অবসরকালীন সুবিধা। একজন ব্যক্তি চাকুরিতে নিযুক্ত থাকাকালীন তার বেতনের কিছু অংশ যার সাথে সরকার কিছু অংশ যোগ করে আলাদা পেনশন তহবিলে রাখা হয় যা চাকুরি থেকে স্বেচ্ছায়, মৃত্যু, অক্ষমতা বা আইনগত কারণে অবসরে যাওয়ার পর ঐ তহবিল থেকে পর্যায়ক্রমিক আর্থিক ও কল্যাণমূলক সুবিধা ভোগ করে থাকে। এই সুবিধা স্বামী বা স্ত্রীর জীবনকাল এবং কারো মৃত্যুতে তাদের প্রতিবন্ধী সন্তান জীবনকাল পর্যন্ত পেয়ে থাকে। কেউ চাইলে আংশিক বা পুরোপুরি পেনশন সারেন্ডার করে মধ্যবর্তী বা এককালীন আর্থিক সুবিধা ভোগ করতে পারে।
এটাই বাংলাদেশ সার্ভিস রুলসের অধীনে প্রচলিত পেনশন পদ্ধতি যা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য। মিলিটারি সার্ভিসের ক্ষেত্রেও প্রায় একই রকম পেনশন পদ্ধতি চালু আছে। কিন্তু এর বাইরে বেসরকারি চাকরিজীবী, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, প্রবাসী, অনিবাসী বাংলাদেশী বা সাধারণ জনগণের জন্য এই রকম বা সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি নাই।
সরকারি বলতে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগকৃত বিসিএস, বিজেএস, সরকারি অন্যান্য নিয়োগে কর্মকর্তা ও কর্মচারী, মিলিটারি সার্ভিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণকে বুঝায়। আধা সরকারি স্বায়ত্তশাসিত স্বশাসিত বা রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠানগুলিতে কর্মরত কর্মকর্তা কর্মচারীগণও এর অন্তর্ভুক্ত। এর বাইরে সকল লোকজনই বেসরকারি খাত।
এই প্রচলিত পদ্ধতির উন্নতি কল্পে সরকার বাংলাদেশে সকলের জন্য প্রযোজ্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা করতে “সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩” পাশ করেছে যা ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ ইং তারিখ থেকে কার্যকর হয়।
এই আইনের অধীনে গঠিত পেনশন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ‘সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা, ২০২৩’ এর আওতায় এখনও পর্যন্ত পাঁচটি পেনশন প্ল্যান চালু করেছে।
১. প্রবাস: প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য প্রযোজ্য।(ঐচ্ছিক/স্বেচ্ছাধীন)
২. প্রগতি: বেসরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী বা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য। (ঐচ্ছিক/স্বেচ্ছাধীন)
৩. সুরক্ষা: স্বকর্ম ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মীদের জন্য প্রযোজ্য। (ঐচ্ছিক/স্বেচ্ছাধীন)
৪. সমতা: স্বল্প আয়ের ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য। (ঐচ্ছিক/স্বেচ্ছাধীন)
৫. প্রত্যয়: স্ব-শাসিত স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য। (প্রথমে ঐচ্ছিক/স্বেচ্ছাধীন পরে বাধ্যতামূলক)
১৩ মার্চ ২০২৪ সালে ‘প্রত্যয়’ স্কিম বাধ্যতামূলক করে প্রকাশনার পরেই আইনটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে যা ১লা জুলাই থেকে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে প্রযোজ্য হয়েছে। ২০২৪ সালে ৪৭ নং এসআরও এর মাধ্যমে সকল স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ব, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং এদের অধীনস্থ অঙ্গ প্রতিষ্ঠানসমূহের চাকরিতে যে সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী, তারা যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, ১লা জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ তারিখ ও তৎপরবর্তী সময়ে নূতন যোগদান করবে তাদেরকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত হতে হবে যা মূল আইনে আওতা বহির্ভূত বা ঐচ্ছিক ছিল।
এই ৪৮ নং এসআরও তে সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা ২০২৩ এর বিধি ২ এর উপবিধি ১ এ নতুন দফার সংযোজন এর মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ও স্ব-শাসিত বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। বিধি ২ (১) (ঘঘ): ‘রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান’ অর্থ সরকার অথবা কোন স্বায়ত্তশাসিত বা স্ব-শাসিত সংস্থার মালিকানাধীন বা উহিতে ন্যস্ত অথবা শতকরা ৫০ ভাগের অধিক সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত কোন ব্যবসায় উদ্যোগ, কোম্পানি, ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান অথবা শিল্প বাণিজ্য সম্পর্কিত বা অনুরূপ কোন প্রতিষ্ঠান; বিধি ২ (১) (ঘঘঘ): ‘স্ব-শাসিত বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা’ অর্থে আপাতত বলবৎ কোন আইন দ্বারা অথবা উহার অধীন অধিষ্ঠিত বা গঠিত কোনো কর্তৃপক্ষ, কর্পোরেশন, কমিশন, সংস্থা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউশন, কাউন্সিল, একাডেমী, ট্রাস্ট, বোর্ড বা ফাউন্ডেশন, উহা যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, অন্তর্ভুক্ত হইবে;
এই প্রত্যয় স্কিমের বাধ্যতামূলক করা নিয়েই বিতর্কের সূত্রপাত। এই নীতিটি বৈষম্য মূলক। সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলক না করে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাধ্যতামূলক করার প্রতিবাদে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান যেমন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এই বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একযোগে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। তাদের মতে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাধ্যতামূলক করা বৈষম্যমূলক। প্রত্যয় স্কিম বাধ্যতামূলক করার ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষকগণ প্রচলিত পেনশন পদ্ধতির চেয়ে কম সুবিধা পাবেন। এটা বৈষম্যমূলক ও সংবিধানের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক ও বেআইনি।
চাকরিতে যোগদানের সময় যে প্রত্যাশিত সুবিধা প্রাপ্তির কথা ছিল চাকরি করাকালীন এই আইন সেই সুবিধা কেড়ে নিচ্ছে যা আমাদের মহান সংবিধান, আইনবিজ্ঞান ও মানবাধিকার পরিপন্থী। সর্বজনীন পেনশন স্কিম উত্তরাধিকারী ও প্রতিবন্ধী সন্তানদেরকে বঞ্চিত করবে যা অন্যায়। প্রচলিত পেনশন পদ্ধতির এই সুবিধা দেখে অনেক শিক্ষকই চাকরিতে যোগদান করেছিল, এখন এই সুবিধা কেড়ে নেওয়াটা তাদের প্রতি অবিচারের শামিল।
এই অন্যায় ও বেআইনি বিধানের প্রতিবাদে সম্প্রতি তারা সারা দেশে, সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন সহ অন্যান্য কর্মসূচি পালন করছে সংবাদে প্রকাশ।
সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি যেন ‘উপরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট’ প্রবাদের মতোই। নতুন আইন অনেক গোছানো প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও ভেতরের অগোছালো ও অব্যবস্থাপনা যেন পিছু ছাড়ছে না। নামের সর্বজনীন হলেও প্রকৃত অর্থে সকলের জন্য তা জনীন নয়। সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে বাদ দিয়ে অন্যান্য সকলকে অন্তর্ভুক্ত করার এই পেনশন ব্যবস্থাপনা কার্যত সর্বজনীন নয়। সর্বজনীন নামের সাথে শুভংকরের ফাঁকি যুক্ত হয়েছে বলেই আজ সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। আন্দোলনে নেমেছে সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
সর্বজনীনের আভিধানিক অর্থ সর্বসাধারণের জন্য প্রযোজ্য এমন কিছু! সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন ২০২৩ সরল চোখে পড়লে এটাই বুঝায় যে আইনটি বাংলাদেশের সরকারি আধা সরকারি বেসরকারি সকল নাগরিকের জন্য সমানভাবেই প্রযোজ্য হবে। কিন্তু শতভাগ সরকারি বা মিলিটারি সার্ভিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য এই আইন এখনো প্রযোজ্য নয় বলে সর্বজনীনতার প্রশ্ন আইনটি উত্তীর্ণ হয়নি। প্রচলিত পেনশন পদ্ধতি এবং সর্বজনীন পদ্ধতির মধ্যে সুবিধা প্রাপ্তির বৈষম্য আছে। একই দেশে দুই নীতি থাকায় তা বৈষম্যমূলক দৃশ্যমান। দুই পদ্ধতিতেই আর্থিক সুবিধা সমান হলে সবাই একই পদ্ধতি গ্রহণ করবে না কেন? আমলারা বেশি সুবিধার প্রাপ্তির জন্য আইন প্রণেতাদেরকে সঠিক পরামর্শ দিচ্ছেন না মর্মেও অভিযোগ রয়েছে।
আইন ও বিধি-বিধানের দুর্বল দিকসমূহ হল-
১. প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা কম যা অযৌক্তিক।
২. সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য নয়।
৩. আমলাদেরকে সুবিধা দেওয়ার জন্যই এই বৈষম্যমূলক আইন তৈরি করা হয়েছে।
৪. বাংলায় আইন প্রণয়নের বিধান থাকলেও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে আইনের নামকরণ সহ গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭’ এর লঙ্ঘন।
৫. নিয়মানুযায়ী ৭৫ বছর পর্যন্ত পেনশন সুবিধা পাবে যা প্রচলিত আইনে স্ত্রীর জীবনকাল কিংবা প্রতিবন্ধী সন্তানও পেনশনের কল্যাণমূলক সুবিধা পেত।
৬. প্রতিবন্ধীদের সুবিধার ক্ষেত্রে এটি বেআইনি বা অসাংবিধানিক।
৭. উত্তরাধিকারী ও প্রতিবন্ধী নাগরিকদের সাথে রাষ্ট্র এমন জঘন্য আচরণ করতে পারে না যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা পাকিস্তানি শোষণকেও হার মানায়।
৮. তথ্যপ্রধানের জন্য তথ্য কর্মকর্তা নাই।
৯. আপিল আদালত নাই, আপিল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, আপিল আদালত না থাকায় পেনশন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে।
১০. এ ধরনের বিধান সমাজকে ভারসাম্যহীন করবে।
১১. ঐচ্ছিক স্কিমগুলির তুলনায় বাজারে প্রতিযোগিতামূলক বা অধিক সুবিধারমূলক স্কিম থাকায় এই স্কিম গুলি আলোর মুখ দেখবে না।
সর্বজনীন পেনশন নীতিমালা সরকারের অদক্ষ ও দুর্বল নীতির পরিচয়। জনকল্যাণের জন্য সর্বজনীন পেনশন নীতির দুর্বলতা দূর করে, বৈষম্যমূলক বিধান ভারসাম্যপূর্ণ করলে, আর্থিক সুবিধার বিষয় প্রচলিত পদ্ধতির সমান কিংবা বেশি করলে, আমলারা অর্থহীন দাম্ভিকতা পরিহার করলে, আইন প্রণেতারা জনস্বার্থ বুঝতে পারলে, সারাদেশে ফুঁসে ওঠা জন দাবি মেনে নিলেই বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণ একটি টেকসই পেনশন কাঠামো পাবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: মীর হালিম, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও পাবলিক পলিসি অ্যানালিস্ট email: adv.mirhalim@gmail.com
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম -এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম কর্তৃপক্ষের নয়।