সাধারণ মানুষ আইনি সমস্যার মুখোমুখি হলে দ্বারস্থ হন আদালতের। এক্ষেত্রে অনেক সময় বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাদের। অনেকেই অসাধু চক্রের খপ্পরে পড়ে হন ক্ষতিগ্রস্ত। কেউ আবার মিথ্যা মামলার ভুক্তভোগী হয়ে বছরের পর বছর হয়রানির শিকার হন। বিচারের জন্য দৌড়াতে হয় আদালতের দরজা থেকে এজলাসে। গুনতে হয় টাকা, অপচয় হয় সময়। অনেক সময়ই তারা ন্যায়বিচার পান না।
তবে দ্রুত বিরোধ নিষ্পত্তি এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়ে প্রশংসায় ভাসছেন পঞ্চগড়ের বিচারক আবু সাঈদ। জ্যেষ্ঠ সহকারী বিচারক পদমর্যাদায় তিনি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন।
জেলায় যোগদানের পর থেকেই বিভিন্ন বিরোধ সহজে নিষ্পত্তির মাধ্যমে প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। গুরুত্বপূর্ণ বিরোধ নিরসনে ছুটে যাচ্ছেন প্রত্যন্ত এলাকায়। পরিদর্শন করছেন ঘটনাস্থল।
সম্প্রতি একটি জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আবু সাঈদ হাজির হন সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের জলাপাড়া এলাকায়। তার সঙ্গে ছিলেন পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিরা। দুই পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে পরিদর্শন করেন বিরোধীয় জমি। আশ্বাস দেন দ্রুত সমাধানের।
জমির বিরোধ, নারী নির্যাতনসহ বিচ্ছেদে দায়ের করা মামলায় যেখানে দীর্ঘ শুনানিতে অপেক্ষা করতে হয়, ঠিক সেখানে মামলার জট নিরসনে ভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে লিগ্যাল এইডের বিচারক আবু সাঈদ। দায়ের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এক থেকে দেড় মাসে জটিল বিরোধ সহজেই করছেন নিষ্পত্তি।
আরও পড়ুন: লিগ্যাল এইডে আমার ভূমিকা নেই, সব আমলা : প্রধান বিচারপতি
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবু সাঈদ যোগদানের পর থেকেই বিচারপ্রত্যাশীদের আস্থা বেড়েছে। আগে এই অফিস থাকলেও মানুষ বিচারের জন্য তেমন আসতেন না। কিন্তু তিনি আসার পর থেকে বিচারপ্রার্থীদের ভিড় বেড়েছে লিগ্যাল এইড অফিসে। জমি সংক্রান্ত মামলা জটিল হলে সরাসরি ঘটনাস্থলে ছুটে যাচ্ছেন তিনি।
মেডিয়েশন (মামলা নিষ্পত্তির বিকল্প পথ) বিষয়ে প্রচারমূলক ও উদ্বুদ্ধ করার সভাও করছেন বিভিন্ন গ্রাম ও ইউনিয়নে। প্রতি মাসে অন্তত দুটি মামলা সমাধান করছেন সরেজমিন পরিদর্শন করে। এ ছাড়া তিনি গরিব ও অসহায় বিচারপ্রার্থীদের সরকারি খরচে আইনি সেবাসহ বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের কৃষক সাবুল ইসলাম বলেন, ‘গত ১২ মে জমি বিরোধের জেরে লিগ্যাল এইড অফিসে অভিযোগ করি। এতে এক টাকাও খরচ হয়নি আমার। মুহুরি বা আইনজীবী কারোর ধন্যাও ধরতে হয়নি। বিচারক আবু সাঈদ সরেজমিন এসে দ্রুত সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। একজন বিচারক ঘটনাস্থলে আসবেন, এটা আমি কোনো দিনও ভাবিনি। বিচারকের আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ। ন্যায়বিচার পাব বলে আশা করছি।’
একই কথা বলেন ওই গ্রামের বৃদ্ধ শামসুল হক, ‘এটা নজিরবিহীন ঘটনা। জীবনে কখনো দেখিনি একজন বিচারক হয়েও ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে বিরোধ মেটাচ্ছেন।’
তরিকুল ইসলাম নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ করা হয় লিগ্যাল এইড অফিসে। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। আমাদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। একজন বিচারক বাড়িতে এসে সমস্যা সমাধান করে দিচ্ছেন, এতে আমরা গর্বিত। জেলার গরিব অসহায়রা এভাবে বিচার পেলে আর কোনো দালালের খপ্পরে কিংবা টাকা খরচ করতে হবে না।’
আরও পড়ুন: ‘লিগ্যাল এইড আমাদের সংসার ফিরিয়ে দিয়েছে’
হাফিজাবাদ ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য আল মামুন বলেন, ‘কিছু কিছু বিরোধ আমরা ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে সমাধান করতে ব্যর্থ হই। পরে সমাধানের জন্য উভয় পক্ষই আদালতে গিয়ে বছরের পর বছর ঘুরি। কিন্তু লিগ্যাল এইড অফিসে অভিযোগ করার দুই মাসের মাথায় বিচারক নিজে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এতে বিরোধ শেষ হবে বলে আমরা আশা করছি।’
এদিকে হাফিজাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘লিগ্যাল এইড অফিসের বিচারক আবু সাঈদের বিচার কাজ ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক। বিচারপ্রার্থীরা দ্রুত গতিতে সেবা পাচ্ছেন। কাউকে দিনের পর দিন আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে না। তিনি জেলায় দীর্ঘ সময় থাকলে গরিব ও অসহায় বিচার প্রার্থীরা উপকৃত হবেন। এ ছাড়া সম্পূর্ণ বিনা খরচে বিরোধ নিষ্পত্তি হলে মানুষের হয়রানি কমে যাবে।’
এ বিষয়ে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার (জ্যেষ্ঠ সহকারী বিচারক) আবু সাঈদ বলেন, ‘অসহায় ও দরিদ্রসহ সর্বস্তরের মানুষ যাতে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা পায়, সেই লক্ষ্যে প্রত্যেক জেলায় লিগ্যাল এইড অফিস রয়েছে। যারা অর্থের অভাবে মামলা পরিচালনা করতে পারছেন না, তাদের সহযোগিতা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সব আপসযোগ্য মামলা বিনা খরচে নিষ্পত্তি করা যায় এখানে। এরই ধারাবাহিকতায় আমি নিজে গিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করছি। পাশাপাশি মানুষকে আইনগত সহায়তা সম্পর্কে সচেতন করছি।’
লিগ্যাল এইড অফিস বলছে, গত ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সিনিয়র সহকারী জজ হিসেবে পঞ্চগড় জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে যুক্ত হন বিচারক আবু সাঈদ। এর মাঝে গেল দেড় মাসে বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ পেয়েছেন ১০৩ জন, আইনগত সহায়তা পেয়েছেন ৪৫ জন, মধ্যস্ততায় মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৮০টি।