আরিফ হোসেন: দেওয়ানী কার্যবিধি অনুসারে কোন মামলা ফাইল করার পরবর্তী ধাপ হল অন্য পক্ষকে মামলার কথা জানানো। অন্য পক্ষকে মামলার বিষয়ে জ্ঞাত করানো হয় আদালতের সমন বা নোটিশের মাধ্যমে। দেওয়ানী কার্যবিধিতে মামলা নথীজাত হওয়ার ০৫ দিনের মধ্যে সমন জারি করার জন্য ইস্যু করার বিধান আছে। ০৫ দিনের ভেতর সমন জারির জন্য ইস্যু করা না হলে তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অসদাচরণ হিসাবে বিবেচনা করা হবে।
সাধারণত আদালতের সমন সময়মত ইস্যু করা হলেও সময়মত জারি হয়ে ফেরত আসে না। সমন সঠিকভাবে ও সঠিক সময়ে জারিঅন্তে ফেরত না আসার জন্য যেমনভাবে আদালতের কতিপয় দুষ্ট কর্মচারী জড়িত একই সাথে সমন জারির বর্তমান প্রথাও কম দায়ী নয়।
একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝালে বিষয়টি সহজ হবে। ধরুন আদালতের একজন জারিকারকের একটা মামলার ৫০ জন বিবাদীর বিরুদ্ধে সমন জারি করতে হবে যা মোটামুটি জেলা সদর হতে ৫০ কি.মি. দূরে। এত দূরে সমন জারি করার জন্য সরকারি ফি হিসেবে সে সাকুল্যে ৩০/৩৫ টাকা পাবে অথচ এতদূরে তার যাতায়াত খরচই আছে ৫০০/৬০০ টাকা।
তাছাড়া ৫০ জন বিবাদীর বিরুদ্ধে সমন জারি করতে হলে সেই ৫০ জনকে পার্সোনালি খুঁজে বের করতে হবে এবং তাদের কাছে সমন পৌঁছে দিয়ে তাদের সইমোহর নিতে হবে যা জেলা শহর হতে সমন জারির জন্য যাওয়া জারিকারকের জন্য একটি কষ্টসাধ্য কাজ।
একটা জেলা জজ কোর্টে অল্প কয়েকজন মাত্র জারীকারক থাকে তাদের মাধ্যমে এত বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করা নিতান্ত অসম্ভব। সেই কারনে অর্ধেক-অর্ধেক জারি কিংবা গরজারি কিংবা সমন জারি করতে ঘুষ এখানে নিয়ম হয়ে গেছে।
ব্যক্তিগতভাবে বিবাদীদের বিরুদ্ধে জারি ব্যতীত সমন জারির আরও উপায় আছে কিন্তু ওইসব উপায়ে সমন জারিতে সন্দেহ থেকেই যায় যেই কারনে মামলার বিষয়ে জানার পরও সমন সঠিকভাবে জারি হয়নি দাবি করে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা থাকে সর্বত্র।
আদালতের অপ্রতুল জারিকারক ও জেলা সদর হতে দূরবর্তী অংশে সমন জারি সুবিধাজনক না হওয়ায় বিকল্প প্রস্তাব হিসাব স্থানীয় প্রশাসন ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভার মাধ্যমে সমন জারি একটি সুন্দর সমাধান হতে পারে।
আরও পড়ুন: আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হাতকড়ার অপব্যবহার করছে
সাধারণত ১/২ টি গ্রাম নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের একটি ওয়ার্ড গঠিত হয় সেখানে একজন করে চৌকিদার থাকে৷ চৌকিদার সাধারণত উক্ত গ্রামের সবাইকে ভালভাবে চিনে। সুতরাং তার মাধ্যমে সমন জারি করা বর্তমান ব্যবস্থার চেয়ে সুবিধাজনক হবে।
সেক্ষেত্রে সমন জারির ফি বাড়ানোর প্রস্তাব করা যায়৷ প্রত্যেক সমনে ১৫/২০ টাকা করে পেমেন্ট করলে সমন জারি নিয়ে বর্তমান যে সমস্যাগুলো দেখা যায় সেগুলো দেখা যাবে না। জেলা আদালতের নেজারত বিভাগের ভারপ্রাপ্ত জজ, নাজির মিলে পুরো ব্যবস্থার তদারকি করতে পারে তাতে সমন জারিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।
সমন জারিতে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বিবাদী কতৃক সমন রাখতে অস্বীকার করা। বর্তমান ব্যবস্থায় সমন রাখতে অস্বীকার করা পেনাল কোডের ১৭২ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়ার পরও সাধারণত জটিল প্রসিডিউরের কারনে এই ধারার ব্যবহার তেমন দেখা যায় না।
বিবাদী কতৃক সমন রাখতে অস্বীকার করলে জারীকারক কতৃক অভিযোগের প্রেক্ষিতে দেওয়ানী আদালতকে সংক্ষিপ্ত বিচারে শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা দিলে এই সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করা যায়৷
সমন জারিতে আরও একটা সমস্যা যেটা দেখা যায় সেটা হল বাদী কতৃক ইচ্ছেকৃতভাবে বিবাদীদের নাম ঠিকানা ভুল দেয়া। নাম ঠিকানা ভুল হলে সমন বিনা জারিতে ফেরত আসে। যাতে নাম ঠিকানা ভুল না হয় সেজন্য নাম ঠিকানার সাথে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ও মোবাইল নম্বর সংযোজন করার বিধান করা যেতে পারে। এগুলো নিশ্চিত করতে পারলে ভুল নাম ঠিকানা দেওয়ার যে প্রবণতা তা শেষ হয়ে যাবে।
সমন জারিকে দেওয়ানী বিচার পদ্ধতির আরও কয়েকটা ধাপের মত মনে করা হলেও আদতে সমন জারি সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ ধাপ। ত্রুটিপূর্ণ সমন জারির কারনে হাজার হাজার বিবিধ মামলা হয়ে আদালতের কর্মঘন্টার যেমন অপচয় হচ্ছে তেমনি ন্যায়বিচার পেতে বিচারপ্রার্থীদের বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে। শুধুমাত্র সমন জারি সুচারুভাবে করা গেলে বর্তমান বিচার ব্যবস্থার সিংহভাগ অসংগতি দূর করা সম্ভব হয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সহজ হবে।
লেখক: সহকারী জজ, ঝালকাঠি।