উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ কমিশনে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও একজন আইনজীবীকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তিকরণ বৈষম্যমূলক এবং পক্ষপাতিত্বমূলক উল্লেখ করে এই প্রস্তাবের প্রতিবাদ জানিয়েছে বিচারকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন।
আজ সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম সইকৃত এক স্মারকে এই প্রতিবাদ জানানো হয়।
এতে বলা হয়, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের সার্বিক সংস্কারের অংশ হিসেবে বিচার বিভাগ সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্যেই চলতি বছরের গত ৩ অক্টোবর ‘বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন’ গঠনের মাধ্যমে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
সরকারের এই পদক্ষেপকে শুরু থেকেই জেলা আদালতের বিচারকগণ স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পথে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা দূর করার এটাই উপযুক্ত সময়।
বিচারবিভাগ সংস্কার কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী জেলা আদালতের বিচারকগণ তাঁদের মতামত ও সংস্কার প্রস্তাব কমিশনের নিকট উপস্থাপন করেছেন। জেলা আদালতের বিচারকদের সংস্কার প্রস্তাব ইতোমধ্যে প্রশংসিত হয়েছে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে প্রকৃত সংস্কার সাধনই জেলা আদালতের বিচারকদের লক্ষ্য। এর মাধ্যমেই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন হবে বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন।
আরও পড়ুন: বেশ কয়েকজন বিচারপতির অনিয়মের পূর্ণাঙ্গ তদন্তে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন
গত ১১ ডিসেম্বর বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন কর্তৃক দাখিলী প্রাথমিক প্রতিবেদন মারফত এসোসিয়েশন জানতে পারে যে দেশের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ আশ্রয়স্থল বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের বিচারক নিয়োগের নিমিত্ত বিচারবিভাগ সংস্কার কমিশন ৯ (নয়) সদস্য বিশিষ্ট ‘সুপ্রীম কোর্টের বিচারক নিয়োগ কমিশন’ নামে একটি কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে।
কিন্তু উক্ত কমিশনে সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি ও সুপ্রীম কোর্টের অপর একজন আইনজীবীকে সদস্য হিসেবে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। মহামান্য হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগ কমিশনে তাদের অন্তর্ভুক্তি কমিশন গঠনের মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী বলে এসোসিয়েশন মনে করে।
প্রাথমিক প্রতিবেদনের ৬.৩ নং দফা অনুযায়ী একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় মেধা, সততা ও দক্ষতা মূল্যায়নের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য উপায়ে বিচারক নিয়োগের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছে।
কিন্তু বিচারক নিয়োগে সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতিকে সদস্য হিসেবে রাখলে তাতে স্বার্থের সংঘাত (Conflict of Interest) সৃষ্টি হবে এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনৈতিক বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হবে মর্মে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন আশঙ্কা প্রকাশ করছে।
কারণ উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য আইনজীবীগণ এবং জেলা আদালতের বিচারকগণ সাম্ভাব্য প্রার্থী হলেও উক্ত নিয়োগ কমিশনে আইনজীবীদের নির্বাচিত প্রতিনিধি সদস্য থাকা বৈষম্যমূলক এবং পক্ষপাতিত্বমূলক হবে মর্মে জেলা আদালতের বিচারকগণ মনে করেন।
যেখানে বিচারক নিয়োগ কমিশনে মাননীয় প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রীম কোর্টের অন্যান্য বিচারকগন থাকছেন, সেখানে আইনজীবী প্রতিনিধিকে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই মর্মে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন মনে করে।
আরও পড়ুন: জনবল নিয়োগ দেবে সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতি
সুপ্রীম কোর্ট বারের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার উদাহরণ অতীতে অনেক আছে এবং ভবিষ্যতেও এই সম্ভাবনা নাকচ করার সুযোগ নেই। ভবিষ্যতে বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নির্বাহী কিংবা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ আর যাতে না থাকে তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি; অন্যথায় তা জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের চেতনার পরিপন্থী হবে।
বিজ্ঞ আইনজীবীদের কাউকে বিচারক নিয়োগ কমিশনে অন্তর্ভুক্ত করা হলে পূর্বের মতো বিচারক নিয়োগে রাজনৈতিক প্রাধান্য বৃদ্ধি পাবে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।
দাখিলী প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন একটি অধ্যাদেশের খসড়া ইতোমধ্যে আইন ও বিচার বিভাগে প্রেরণ করেছে, যা জেলা আদালতের বিচারকদের মধ্যে গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে।
জেলা আদালতের বিচারকদের আশঙ্কা, এই প্রস্তাবের ফলে পূর্বের মতো তাঁরা উচ্চ আদালতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বৈষম্যের শিকার হবেন। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে এমন একটি পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের বৈষম্যের কোনো সুযোগ না থাকে।
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলা আদালতের বিচারকদের প্রতি বৈষম্য রোধে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন জেলা আদালত থেকে কমপক্ষে ৭০% (শতকরা সত্তর ভাগ) বিচারক নিয়োগের জন্য সুস্পষ্ট বিধান প্রণয়নের দাবি জানাচ্ছে।
পাশাপাশি, বিচারক নিয়োগে বয়স ও অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে উপযুক্ত নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানাচ্ছে। জেলা আদালতের বিচারকদের প্রধান কাজ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হলেও তাঁরাই যদি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বৈষম্যের শিকার হন তবে তা বিচার বিভাগের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করবে।
আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, বিচারক নিয়োগ কমিশনে সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি, আইনজীবী কিংবা কোনো পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এটি শুধু স্বার্থের সংঘাতই সৃষ্টি করবে না বরং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পক্ষপাতিত্ব ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ঝুঁকি বাড়াবে। বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন একটি নিরপেক্ষ ও ন্যায্য নিয়োগ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানায় বিচারকদের এই সংগঠন।