হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে নারী-পুরুষ সমান অধিকার
অ্যাডভোকেট মোকাররামুছ সাকলান

বিচারক নিয়োগ কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে কেন প্রতিবাদ হলো

মোকাররামুছ সাকলান: বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েসন (বাজুসাএ) গতকাল যে প্রতিবাদ পত্র দিয়েছে তাতে সুপ্রিম কোর্ট বিচারক নিয়োগ কমিশনে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং যেকোন আইনজীবীকে অন্তর্ভুক্ত করার বিরুদ্ধে, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ উত্থাপন করে এর বিরোধীতা করেছে।

এই লেখাটি মূলত সেই প্রতিবাদ পত্রের একটি বিশ্লেষণ যেখানে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েসন এর মহাসচিবের স্বাক্ষরিত বক্তব্যবের ত্রুটিসমুহ চিহ্নিত করে, বিশেষ করে সমাজ এবং বিচার ব্যবস্থায় আইনজীবীদের ভূমিকা নিয়ে যে আশংকাজনক বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে তার একটি বিশ্লেষণ এই লেখায় তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। এই লেখায় কিছু প্রস্তাবনাও আছে যা বিশ্লেষণের সাথে সাথে বর্ণনা করা হয়েছে।

১. বিচার ব্যবস্থায় আইনজীবীদের অপরিহার্য ভূমিকার উপেক্ষা

প্রতিবাদ পত্রে আইনজীবীদের বিচার ব্যবস্থায় ভূমিকা মূল্যায়ন করে করা হয়নি। আইনজীবীরা আইন ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগে, ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে এবং নাগরিকের অধিকার রক্ষায় একটি মৌলিক ভূমিকা পালন করেন। তাদের আদালতে অভিজ্ঞতা তাদেরকে আইন ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ এবং সংস্কারের সম্ভাবনা সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।

যেহেতু আইনজীবীদের অভিজ্ঞতা এবং আইন ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ এবং সংস্কারের সম্ভাবনা সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি বিচারক নিয়োগে সঠিক ভূমিকা পালন করবে সেখানে, তাই আইনজীবীদের কমিশনে অন্তর্ভুক্ত না করা ফলপ্রসূ নয় এবং বিচার ব্যবস্থার উন্নয়নে তাদের অবদানের প্রতি অবজ্ঞা করা। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েসন এর প্রতিবাদ লিপিতে সেই অবজ্ঞাটি ফুটে উঠেছে সারাক্ষন।

২. স্বার্থের সংঘাতের ভিত্তিহীন ধারণা

প্রতিবাদ পত্রে দাবি করা হয়েছে যে আইনজীবীদের কমিশনে অন্তর্ভুক্তি স্বার্থের সংঘাত (Conflict of Interest) সৃষ্টি করবে। এই যুক্তি ত্রুটিপূর্ণ, কারণ একটি শক্তিশালী এবং স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া স্পষ্ট নির্দেশিকা সহ যেকোনো সম্ভাব্য সংঘাত মিটিয়ে দিতে পারে। যেমন বিচারকরা যদি তাদের পেশায় পক্ষপাতিত্ব এবং পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয় তবে সেই একই যুক্তিতে একজন দক্ষ ও ভালো ও সৎ আইনজীবী বিচারক নিয়োগ কমিশনে পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সক্ষম হবে।

এছাড়া, যুক্তিটি উপেক্ষা করে যে বিচারকরা নিজেদের আইনগত অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসেন। এই যুক্তি অনুসারে, কোনো বিচারক, যিনি পূর্বে আইনজীবী ছিলেন, তার পক্ষ থেকে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলা অযৌক্তিক হবে।

৩. নিম্ন আদালত থেকে ৭০% নিয়োগের দাবি

বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন (BJSA)-এর উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে নিম্ন আদালত থেকে ৭০% কোটা নির্ধারণের দাবি একটি বিতর্কিত প্রস্তাব, যা ন্যায্যতা, মেধাবৃত্তি, এবং বিচার বিভাগের বহুমুখীতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এমন কোটাভিত্তিক পদ্ধতির কিছু মৌলিক দুর্বলতা রয়েছে।

৪. মেধাবৃত্তির ক্ষতি

কোটাভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া মেধা ও যোগ্যতার চেয়ে পেশাগত পটভূমিকে অগ্রাধিকার দেয়। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের মূল উদ্দেশ্য হলো এমন বিচারকদের নির্বাচন করা, যারা দক্ষতা, সততা, এবং আইন ব্যবস্থায় ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম। ৭০% কোটার মতো প্রস্তাব আইনজীবীদের মতো দক্ষ প্রার্থীদেরকে বাদ পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করে, যা বিচার ব্যবস্থার মানকে খর্ব করতে পারে।

৫. অন্যায্য অধিকারের মনোভাব তৈরি

নিম্ন আদালতের বিচারকদের জন্য ৭০% কোটা দাবি তাদের মধ্যে একটি অযৌক্তিক অধিকারবোধ সৃষ্টি করে। উচ্চ আদালতে নিয়োগ কোনো ক্যারিয়ার অগ্রগতির অংশ নয়; বরং এটি একটি কঠোর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য বিচারক নির্বাচন করার বিষয়। এই ধরনের প্রস্তাব উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগকে পুরস্কারের মতো দেখানোর ঝুঁকি তৈরি করে, যা নিয়োগ প্রক্রিয়ার মূল চেতনাকে ক্ষুণ্ণ করে।

৬. বিচার বিভাগের ভিন্নমত বিনিময়ের সীমাবদ্ধতা

একটি কার্যকর বিচার বিভাগে বিভিন্ন পেশাগত পটভূমি থেকে বিচারকদের অবদান নিশ্চিত করতে হয়। আইনজীবীরা আইনি প্রতিনিধিত্ব, সাংবিধানিক সমস্যা এবং বাণিজ্যিক বিরোধ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে আসেন। অপরদিকে, নিম্ন আদালতের বিচারকগণ প্রক্রিয়াগত দক্ষতা এবং বিচারিক সিদ্ধান্তের অভিজ্ঞতা প্রদান করেন। একপাক্ষিক প্রতিনিধিত্ব চিন্তার স্থবিরতা সৃষ্টি করতে পারে এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে বাধা হতে পারে।

৭. অধস্তন আদালতের বিচারকদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব

BJSA-এর দাবি যে হাই কোর্টের নিয়োগের ৭০% জেলা বিচারকদের জন্য সংরক্ষিত থাকতে হবে, তা একটি স্বার্থপর পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ করে। যদিও জেলা বিচারকরা বিচার ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবুও নিয়োগের প্রধান মানদণ্ড হিসেবে যোগ্যতা এবং দক্ষতা থাকা উচিত। এমন কোটা প্রথা বাস্তবায়ন হলে আইনজীবী পেশার যোগ্য প্রার্থীরা অবিচারভাবে বাদ পড়তে পারেন, যা merit-based বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরিপন্থী।

৮. মানসম্পন্ন বিচারক না তৈরির ঝুঁকি

নিম্ন আদালত থেকে অধিক সংখ্যক নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালিত হলে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে, যেখানে বিচারকগণ নিজেরাই নিজেদের পেশার সদস্যদের প্রাধান্য দেবেন। তদ্ব্যতীত, কোটাভিত্তিক নিয়োগ যোগ্যতার চেয়ে কোটাকে গুরুত্ব দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে, যা বিচার বিভাগের মানকে খর্ব করতে পারে।

৯. বিচার বিভাগের উন্নয়নে আইনজীবীদের ভূমিকার প্রতি অবজ্ঞা

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, অনেক স্বনামধন্য বিচারক আইনজীবী পেশা থেকে উঠে এসেছেন। বিশেষ করে উচ্চ আদালতে কর্মরত আইনজীবীরা জটিল আইনগত ও সাংবিধানিক বিষয়গুলো সম্পর্কে অধিক সচেতন থাকেন, যা তাঁদের উচ্চ আদালতের জন্য যোগ্য প্রার্থী করে তোলে। ৭০% কোটা এই দক্ষ প্রার্থীদের সুযোগ কমিয়ে দেয়, যা বিচার বিভাগের উন্নয়নের জন্য প্রতিকূল।

১০. জনগণের প্রত্যাশার সাথে অসামঞ্জস্যতা

জনগণ আশা করে যে উচ্চ আদালতের বিচারকগণ সর্বোচ্চ মানের আইনি দক্ষতা এবং নৈতিকতার অধিকারী হবেন। কোটাভিত্তিক পদ্ধতি এই বিশ্বাসকে দুর্বল করে দিতে পারে, কারণ এটি এমন ধারণা দেয় যে নিয়োগ প্রক্রিয়া যোগ্যতার চেয়ে পেশাগত পদমর্যাদার উপর নির্ভরশীল। এর ফলে বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনসাধারণের আস্থা হ্রাস পেতে পারে।

১১. রাজনৈতিক প্রভাবের প্রতি ভিত্তিহীন ভয়

আইনজীবীদের অন্তর্ভুক্তি রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করবে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা বিচার ব্যবস্থার মধ্যে থাকা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের ধারণাকে অস্বীকার করে। বিশেষ করে, আইনজীবীরা, যারা নেতৃত্বমূলক পদে আছেন, প্রায়ই পেশাদার নৈতিকতার উচ্চমান প্রদর্শন করেন। তাদের পেশার ওপর ভিত্তি করে প্রক্রিয়া নষ্ট করার অভিযোগ তোলা একেবারেই বাস্তবতা বিবর্জিত এবং অপ্রমাণিত।

১২. আইনি সংস্কারের প্রাণপুরুষ

আইনজীবীরা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ আইনি এবং সাংবিধানিক সংস্কার চালিত করেছেন। ভূলে গেলে চলবে না যে শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরনে আইনজীবীদের ভূমিকা অপরিসীম ছিলো। এখনো আইনজীবীরা সেই স্বাধীন বিচার বুভাগের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। বিচার নিয়োগ কমিশনে আইনজীবীদের অন্তর্ভুক্তি বিচার ব্যবস্থায় সিস্টেমিক সমস্যা সমাধান এবং সামাজিক উপকারে আইনগত সংস্কার আনতে সাহায্য করবে।

১৩. দৃষ্টিভঙ্গির ভারসাম্য

একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের ইনপুট প্রয়োজন, যার মধ্যে আইনজীবীরাও রয়েছে, যাতে এটি DYNAMIC, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমাজের চাহিদার প্রতি অভিযোজিত থাকে।

১৪. আন্তর্জাতিক শ্রেষ্ঠ অনুশীলনের সাথে অসঙ্গতি

বিশ্বব্যাপী, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ কখনোই একক উৎস থেকে সীমাবদ্ধ করা হয় না। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, এবং ভারতের মতো দেশগুলোতে উচ্চ আদালতে বিভিন্ন পেশাগত পটভূমি থেকে নিয়োগের গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভারসাম্য ও বিচারের গুণগত মান নিশ্চিত করতে ৭০% কোটা নির্ধারণ এই শ্রেষ্ঠ অনুশীলন থেকে বিচ্যুত করবে।

১৫. প্রস্তাব কেনো প্রতিবাদ হলো

বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েসন সারা বাংলাদেশ এর অধস্তন আদালতের বিচারকদের একতি সম্মিলিত সংগঠন বলেই জানি। পৃথিবীর অন্য দেশে এমন সার্ভিস এসোসিয়েসন আছে কিনা জানা নেই। তবে একটি প্রস্তাব কখনো প্রতিবাদ লিপি আকারে প্রকাশ হতে পারে না। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েসন সঠিক ফোরামে তাদের প্রস্তাব দিতে পারতেন।

উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে ১০০% কোটা চাইতেন কোন সমস্যা নেই। কিন্তু প্রতিবাদ আকারে যে লেখাটি প্রকাশ হলো তাতে ঢালাও ভাবে আইনজীবীর মুখোমুখি করে ফেলা হলো। বিচারক ও আইনজীবী ছাড়া যে বিচার বিভাগ চলে না এটা ভুলে গেলে কিভাবে হবে। এখানে মুখোমুখি দাড় করার কোন দরকার ছিলো না।

প্রস্তাব যখন প্রতিবাদ হয়েছে তখন বুঝতে হচ্ছে এটি সংকীর্ণ এবং আত্মরক্ষামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে করা হয়েছে। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন যখন প্রস্তাব দেয় তখন তার প্রতিবাদের আগে একবার ভাবা উচিত ছিলো এই সংস্কারের ব্যাকগ্রাউন্ড কি। কোন প্রেক্ষিতে এই বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন হয়েছে। যেকোন প্রস্তাব প্রতিবাদ আকারে যেতে পারে না। প্রস্তাবের যথর্থতা পালটা প্রস্তাব ও যুক্তি দিয়ে খন্ডন করতে হয় প্রতিবাদ দিয়ে নয়।

শেষ কথা

বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েসন-এর প্রতিবাদ পত্রটি বিচার ব্যবস্থার প্রয়োজনের তুলনায় সংকীর্ণ এবং আত্মরক্ষামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্ভূত মনে হয়। সুপ্রিম কোর্ট বিচারক নিয়োগ কমিশনে আইনজীবীদের অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে তোলা আর্গুমেন্টগুলি অনুমানভিত্তিক এবং বিচার ব্যবস্থায় তাদের অপরিহার্য অবদানের প্রতি অবজ্ঞা।

একটি স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া, যেখানে আইনজীবীরাও সদস্য হিসেবে থাকবেন, তা ন্যায়বিচার, বৈচিত্র্য এবং বিচারিক সততার সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করবে। আইনজীবীদের বাদ দেওয়া বিচার ব্যবস্থা এবং বৃহত্তর ন্যায় ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর হবে, যা জনগণের জন্য আরও কার্যকরভাবে সেবা প্রদান করতে সক্ষম নয়।

লেখক: মোকাররামুছ সাকলান; আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট