সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে অভূতপূর্ব, নজীরবিহীন, আলোচিত ও ঘটনাবহুল বছর

সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে অভূতপূর্ব, নজীরবিহীন, আলোচিত ও ঘটনাবহুল বছর

দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে অভূতপূর্ব, নজীরবিহীন, আলোচিত ও ঘটনাবহুল বছর ২০২৪। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, সুপ্রিম কোর্ট থাকবে; ২০২৪ সালের কথা মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হবে। উচ্চ আদালতের একটি ‘বিতর্কিত’ রায়কে কেন্দ্র করে শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। একপর্যায়ে আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। বলতে গেলে ইতিহাস পাল্টে দেয় ওই একটি রায়। এরপর সুপ্রিম কোর্টে একের পর এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়।

২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার দাবির মুখে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতি পদত্যাগ করেন। বিদায়ী বছরেই প্রথম কোনো বিচারপতি হাইকোর্ট বিভাগ থেকে সরাসরি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল পুনর্বহালের রায়, বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানসহ সব আসামিকে খালাসের রায়, জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত ও খালাসের আদেশ, বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণা, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় বাবরসহ সাত আসামিকে খালাসের রায়সহ আলোচিত অনেক রায় ও আদেশ এসেছে উচ্চ আদালত থেকে।

বিদায়ী বছরে উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতিকে লক্ষ্য করে এজলাস কক্ষে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনাও ঘটে। যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। পতিত শেখ হাসিনা সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করার অভিযোগে এ বছরই উচ্চ আদালতের ১২ বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠান প্রধান বিচারপতি।

এ ছাড়া উচ্চ আদালতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের এক আদেশকে কেন্দ্র করে ঢাকায় রিকশাচালকরা তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায়ে ‘স্থিতাবস্থা’ জারি করেন। ফলে আন্দোলন থেকে সরে আসেন রিকশাচালকরা। বিদায়ী বছরে বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থানের পর উচ্চ আদালত থেকে নানা আলোচিত রায় ও আদেশ এসেছে। এ কারণে দেশের মানুষের দৃষ্টি ছিল উচ্চ আদালতের দিকে।

কোটা পুনর্বহাল, হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়

বিদায়ী বছরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ কোটাপদ্ধতি বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।

রায়ে বলা হয়, ২০১২ সালে করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেওয়া রায় ও আদেশ, ২০১৩ সালের লিভ টু আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগে তা বহাল ও সংশোধিত আদেশ এবং ২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারির অফিস আদেশের (মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনির কোটা) আলোকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা পুনর্বহাল করতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হলো। একই সঙ্গে জেলা, নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, উপজাতি-ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোটাসহ, যদি অন্যান্য থাকে, কোটা বজায় রাখতে নির্দেশ দেওয়া হলো। এ বিষয়ে যত দ্রুত সম্ভব, আদেশ পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে পরিপত্র জারি করতে নির্দেশ দেওয়া হলো।

ওই রায়কে কেন্দ্র করে কোটাবিরোধী আন্দোলন ফের প্রকম্পিত হয় রাজপথ। ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে একপর্যায়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। তিনি ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

প্রধান বিচারপতিসহ ৬ বিচারপতির পদত্যাগ

১০ আগস্ট তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেন। পাঁচ বিচারপতি হলেন- এম ইনায়েতুর রহিম, মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. শাহিনুর ইসলাম ও কাশেফা হোসেন।

প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পদত্যাগ দাবিতে সে দিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বর্ধিত ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। ছাত্র-জনতার দাবির মুখে তারা পদত্যাগ করেন। একসঙ্গে ছয় বিচারপতির পদত্যাগ সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এর আগে কখনও হয়নি।

হাইকোর্ট বিভাগ থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ

১০ আগস্ট ওবায়দুল হাসানের পদত্যাগের পর কে হবেন প্রধান বিচারপতি, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। কারণ, ওবায়দুল হাসানের সঙ্গে আপিল বিভাগের আরও পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেন। তখন আপিল বিভাগে মাত্র একজন বিচারপতি অবশিষ্ট ছিলেন। তিনি হলেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম।

বিকেলে খবর আসে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম। মুহূর্তের মধ্যে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে। তখন রাজপথ থেকে দাবি ওঠে, ছাত্র-জনতা প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদকে চান। অন্য কোনো বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে তা মেনে নেওয়া হবে না— বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা এমন ঘোষণা দেন।

অবশেষে ১০ আগস্ট রাতেই বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদকে দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনিই প্রথম বিচারপতি যিনি হাইকোর্ট বিভাগ থেকে সরাসরি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। দেশের বিচার বিভাগে এর আগে এমন ঘটনা ঘটেনি।

সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাকে নিয়োগ দেন। এরপর ১২ আগস্ট আপিল বিভাগে চারজন বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। তারা হলেন— বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি সৈয়দ জিয়াউল করিম, বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক। ১৩ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে বিচারপতিদের শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত

গত ১১ নভেম্বর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের সাজার বিরুদ্ধে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে করা আবেদন) মঞ্জুর করেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে খালেদা জিয়াকে দেওয়া ১০ বছরের সাজাও স্থগিত করেন আদালত। আপিল শুনানি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকবে সাজা।

পাশাপাশি খালেদা জিয়াকে আপিলের সার সংক্ষেপ দুই সপ্তাহের মধ্যে দাখিল করতে নির্দেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে খালাস

গত ২৭ নভেম্বর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে সাত বছরের দণ্ড থেকে খালাস দেন হাইকোর্ট। সাজার বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আপিল মঞ্জুর করে ওই দিন বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।

আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল, অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন, অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া, অ্যাডভোকেট মাকসুদ উল্লাহ, অ্যাডভোকেট আজমল হোসেন খোকন ও ব্যারিস্টার সানজিদ সিদ্দিকী। দুদকের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট আসিফ হোসাইন।

আদালতে শুনানি শেষে আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় খালেদা জিয়া ন্যায়বিচার পেয়েছেন।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার সাজার বিরুদ্ধে গত ২০ নভেম্বর আপিল শুনানি শুরু হয়। ৩ নভেম্বর এ মামলায় খালেদা জিয়ার সাজার বিরুদ্ধে আপিল শুনানির জন্য নিজ খরচে পেপারবুক তৈরির অনুমতি দেন হাইকোর্ট।

২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই সঙ্গে অন্য তিন আসামিকেও সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত। খালেদা জিয়াসহ প্রত্যেককে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া ট্রাস্টের নামে কেনা কাকরাইলে ৪২ কাঠা জমি বাজেয়াপ্ত করে তা রাষ্ট্রের অনুকূলে নেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন খালেদা জিয়া।

তারেক রহমান-বাবরসহ সব আসামি খালাস

গত ১ ডিসেম্বর বহুল আলোচিত একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামিকে খালাস দেন হাইকোর্ট। বিচারিক আদালতের রায় বাতিল করে ১ ডিসেম্বর বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।

বিচারিক আদালত এ মামলায় ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছিলেন।

রায়ে হাইকোর্ট বলেন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার ছিল অবৈধ। আইনে এটা টেকে না। যে চার্জশিটের ভিত্তিতে নিম্ন আদালত বিচার করেছিলেন তা আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না।

১২ বিচারপতিকে পাঠানো হয় ছুটিতে

গত ১৬ অক্টোবর দুর্নীতি ও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের দোসর হিসেবে কাজ করার অভিযোগ ওঠায় ১২ বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এরপর থেকে তাদের আর হাইকোর্টের বেঞ্চে বিচারকাজ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।

ওই ১২ বিচারপতি হলেন— বিচারপতি নাইমা হায়দার, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস, বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার, বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামান, বিচারপতি আতাউর রহমান খান, বিচারপতি শাহেদ নূর উদ্দিন, বিচারপতি মো. আক্তারুজ্জামান, বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম, বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলন, বিচারপতি খিজির হায়াত ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের রোডম্যাপ ঘোষণা

স্বাধীন ও জবাবদিহিতামূলক বিচার বিভাগ গড়ার প্রত্যয়ে গত ২১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ইনার কোর্ট ইয়ার্ডে দেশের বিচারকদের উপস্থিতিতে রোডম্যাপ ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৭ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট হতে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে।  ঘোষিত রোডম্যাপের ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে দেশের উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নে খসড়া করা হয়। গত ২৮ ডিসেম্বর বিষয়টি নিয়ে মতবিনিময় আয়োজন করে আইন মন্ত্রণালয়।

সুপ্রিম কোর্টের বিচার সেবার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে প্রধান বিচারপতি গত ১৮ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে দিক-নির্দেশনামূলক বক্তৃতা দেন। সুপ্রিম কোর্টের সেবা সহজিকরণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং  দুর্নীতি প্রতিরোধে ১২ দফা নির্দেশনা প্রদান করেন। সুপ্রিম কোর্টে আগত কোনো বিচারপ্রার্থী বা সেবাগ্রহীতা সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির কোনো শাখায় সেবা গ্রহণে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলে বা সেবা গ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো অসুবিধার মুখোমুখি হলে উক্ত সেবাগ্রহীতাকে সহায়তা করার নিমিত্ত একটি হেল্পলাইন নাম্বার (+৮৮ ০১৩১৬১৫৪২১৬ ) চালু করা হয়েছে।

ঢাকায় রিকশাচলাচল বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশ, চেম্বারে স্থিতাবস্থা

গত ১৯ নভেম্বর ঢাকা মহানগর এলাকায় তিন দিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশাচলাচল বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এটি বন্ধে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি মাহমুদুর রাজীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

স্বরাষ্ট্র সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, আইজিপি, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের আদালতের এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার এইচ এম সানজিদ সিদ্দিকী ও ব্যারিস্টার তাহসিনা তাসনিম মৃদু।

এ রায়কে কেন্দ্র করে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল করে। চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায়ে স্থিতাবস্থা জারি করেন। পরে আন্দোলন থেকে সরে আসেন রিকশাচালকরা।

এসপি বাবুল আক্তারের জামিন

গত ২৭ নভেম্বর স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারকে জামিন দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমান ও বিচারপতি আলী রেজার হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে বাবুল আক্তারের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির।

দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ১৪ আগস্ট চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে জামিন আবেদন করেন এসপি বাবুল আক্তার। ১৮ আগস্ট বিচারক জামিন নামঞ্জুর করে আদেশ দেন। পরে তিনি হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন। হাইকোর্টের জামিন চেম্বার আদালতে বহাল থাকায় তিনি কারামুক্তি লাভ করেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল সংক্রান্ত বিধান অবৈধ

গত ১৭ ডিসেম্বর বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সংবিধানে গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনেন উচ্চ আদালত। তবে, পঞ্চদশ সংশোধনীর পুরোটা বাতিল করা হয়নি এ রায়ে।

রায়ে হাইকোর্ট বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশে পরিণত হয়েছে। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।

রায়ে আদালত আরও বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটা বাতিল করা হচ্ছে না। বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে আগামী জাতীয় সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে। এর মধ্যে জাতির পিতার স্বীকৃতির বিষয়, ২৬ মার্চের ভাষণের বিষয়গুলো রয়েছে।

১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় বাবরসহ ৭ আসামির খালাস

বিদায়ী বছরে বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সাত আসামিকে খালাস দেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়ার সাজা কমিয়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন করা হয়।

১৮ ডিসেম্বর বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। খালাস পাওয়া অন্য আসামিরা হলেন— এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন তালুকদার, সিইউএফএলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) এ কে এম এনামুল হক, জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী (অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর), সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিল্পসচিব নুরুল আমীন, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম মারা যাওয়ায় তার ক্ষেত্রে মামলা অকার্যকর ঘোষণা করেন আদালত। তবে, তার ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বহাল রাখেন আদালত।

১০ বছরের সাজাপ্রাপ্তরা হলেন— আকবর হোসেন, লিয়াকত, সাহাবুদ্দিন, হাফিজ, মঈনুদ্দিন ও হাজি আব্দুস সোবহান।

বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে সংক্রান্ত রিভিউ নিষ্পত্তি

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের বিধান সংক্রান্ত সংবিধানের বহুল আলোচিত ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ‘রিভিউ’ আবেদন গত ২০ অক্টোবর পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

সেই সাথে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ থেকে বাতিল ২ থেকে ৮ উপ-অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল (রিস্টোর) করে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ রায় দেন।

এই রায়ের ফলে কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অসমর্থতা ও পেশাগত অসদাচরণের কোনো অভিযোগ উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া যাবে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা।

এ রায়ের ফলে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় বহাল রইলো এবং বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছ থেকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ফিরল।

রায়ের আলোকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয়েছে।

কুইক রেন্টাল দায়মুক্তির বিধান অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায়

‘কুইক রেন্টাল’ আইন নামে পরিচিতি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের দায়মুক্তি সংক্রান্ত বিধান অবৈধ ঘোষণা করে গত ১৪ নভেম্বর রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। এই আইনের অধীনে করা কাজ নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না এবং চুক্তি করার বিষয়ে মন্ত্রীর একক সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রশ্নে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় ঘোষণা করা হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটি ২০১০ সালের ১২ অক্টোবর প্রণয়ন করা হয়। আইনের ‘পরিকল্পনা বা প্রস্তাবের প্রচার’-সংক্রান্ত ৬(২) ধারা ও ‘আদালত ইত্যাদির এখতিয়ার রহিত করা’-সংক্রান্ত ৯ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিটটি করা হয়।

আদালতের এখতিয়ার রদ করতে পারে এমন কোনো আইন হতে পারে না। এটা চ্যালেঞ্জ করা হয়।

ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে পরিচালিত গণহত্যা-মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে পরিচালিত হত্যা-গণহত্যার বিচার হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা হয়েছে।

গত ১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হাইকোর্টের বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার। ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেলের অপর দুই সদস্য হলেন- হাইকোর্টের বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

গত ৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। আরো বেশ ক’জন আইনজীবীকে প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১০ জন কর্মকর্তার সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়েছে। যেখানে তদন্ত সংস্থার কোঅর্ডিনেটর পদে মো. মাজহারুল হককে (অ্যাডিশনাল ডিআইজি, অবসরপ্রাপ্ত) এবং কো-কোঅর্ডিনেটর পদে মুহাম্মদ শহিদুল্যাহ চৌধুরীকে (পুলিশ সুপার, অবসরপ্রাপ্ত) নিয়োগ দেওয়া হয়।

ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত ১৭ অক্টোবর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

ইতোমধ্যে পতিত আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী উপদেষ্টা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাসহ বেশ কিছু কর্মকর্তাকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে তারিখ ধার্য রয়েছে।