অগ্রক্রয় অধিকার কি?
যদি কোন জমির মালিক উক্ত জোতের কোন শরিক বা সহ শরিক ব্যতিত অপর কোন ব্যক্তির নিকট তার জমি বিক্রি করে তবে ঐ জোতের কোন শরিক উক্ত সম্পত্তি নিজে প্রাপ্তির লক্ষ্যে বিক্রয় মূল্য ও নির্ধারিত হারে ক্ষতিপূরণ প্রদান করে আদালতের মাধ্যমে নিজে মালিকানা পাওয়ার আইনত: অধিকারী হবে আর এই অধিকারকেই অগ্রক্রয় অধিকার বলে।
সহজ ভাবে অগ্রক্রয় অধিকার বলতে বুঝায় যে, জমি বিক্রির ক্ষেত্রে উক্ত জমি উত্তরাধিকার সূত্রে আত্মীয় এবং জমির শরিকদের ক্রয় করার অধিকার আইনে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তাদের আইনগত এই অধিকার খর্ব করে ভিন্ন আগন্তুক কোন ব্যক্তির নিকট কোন জমি বিক্রি করলে উক্ত আত্মীয় বা শরিকদের মধ্য থেকে কেউ ক্রয়ে আগ্রহী থাকলে তিনি আদালতের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে উক্ত জমির মালিক হতে পারবেন। আদালতের মাধ্যমে প্রদত্ত এই অধিকারকে অগ্রক্রয় অধিকার বলে।
The State Acquisition and tenancy Act. 1950 এর ৯৬ ধারা অনুসারে কৃষি জমির ক্ষেত্রে অগ্রক্রয় অধিকার প্রদান করা হয়েছে। অপর দিকে The Non Agricultural tenancy Act. 1949 এর ২৪ ধারা অনুসারে অকৃষি জমির ক্ষেত্রে অগ্রক্রয় অধিকার প্রদান করা হয়েছে।
উদাহরণের মাধ্যমে অগ্রক্রয় অধিকার
উদাহরণ: ১
মনে করেন জনি ও রনি দুই ভাই বাবার উত্তরাধীকারী হিসাবে মোট ১০ শতাংশ সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। এর মধ্যে রনির টাকার প্রয়োজন হওয়ায় তার অংশের ৫ শতাংশ জমি বিক্রি করে দিবেন। যদি জনির উক্ত জমি ক্রয়ের সামর্থ ও ইচ্ছা থাকে তাহলে সেই জমি ক্রয়ে জনির অধিকার সবার আগে, জনির এই অধিকারই অগ্রক্রয় অধিকার। ধরুন রনি ও জনির মধ্যে সম্পর্ক ভালো না থাকায় রনি ভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করবে কিন্তু জনির কাছে বিক্রি করবে না। জনির জমি ক্রয়ের সামর্থ ও ইচ্ছা থাকার পরও যদি রনি ভিন্ন লোকের নিকট বিক্রি করে তাহলে জনি আদালতে অগ্রক্রয়ের অধিকার চেয়ে মোকাদ্দমা দায়ের করতে পারবেন।
উদাহরণ: ২
মি. হাফিজ তার জমি উক্ত জমির কো—শেয়ারার বরাবর হস্তান্তর না করে মি. হাবিব বরাবর বিক্রয় করেছেন যেখানে মি. হাবিব একজন আগন্তুক। জমির কোন কো—শেয়ারার উক্ত হস্তান্তরের বিরুদ্ধে মোকাদ্দমা দায়ের করেন নি। পরবতীর্তে মি. হাবিব উক্ত জমি ভিন্ন কোন ব্যক্তির বরাবর পূনরায় বিক্রয় করেন। এমতবস্থায় কো—শেয়ারার বিষয়টি জানতে পারল। অর্থ্যাৎ কো—শেয়ারার এর জানার আগেই জমিটির দ্বিতীয় হস্তান্তর সম্পন্ন হয়েছে। উক্ত দ্বিতীয় হস্তান্তর হওয়ার পরও অগ্রক্রয় অধিকার বিদ্যমান থাকে কি না তা নিয়ে ৩৫ ডি এল আর ২৩৮ স্পষ্টভাবেই উল্লেখ রয়েছে যে দ্বিতীয় হস্তান্তর সম্পন্ন হওয়া পরেও কো—শেয়ারার এর অগ্রক্রয় অধিকার বিদ্যমান থাকে।
উদাহরণ: ৩
মি. হাফিজ তার জমি উক্ত জমির কো—শেয়ারার বরাবর হস্তান্তর না করে মি. হাবিব বরাবর বিক্রয় করেছেন যেখানে মি. হাবিব একজন আগন্তুক। পরে বিষয়টি জানা জানি হলে মি. হেকমত (কো—শেয়ারার) উক্ত হস্তান্তরের বিরুদ্ধে মোকাদ্দমা দায়ের করার সিদ্ধান্ত নেন। এমতাবস্থায় মি. হাবিব উক্ত কো—শেয়ারারে অগ্রক্রয় অধিকার খর্ব করার লক্ষ্যে ক্রয়কৃত জমি উক্ত জমির আরেকজন কো—শেয়ারার জনাব শরিবুল বরাবর হস্তান্তর করেন এবং ঘোষনা করেন যে যেহেতু জমিটি এখন উক্ত জোতের আরেকজন কো—শেয়ারার এর মালিকানাধীন রয়েছে অতএব মি. হেকমতের অগ্রক্রয় অধিকার আর বিদ্যমান নেই। ১০(১) এল এন জি ২০২১ পাতা: ২১০ প্যারা: ২৩ এ স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে আগন্তুক কর্তৃক ক্রয়কৃত জমি হস্তান্তরের মাধ্যমে মূল দাতা ভিন্ন অন্য কোন কো—শেয়ারারে বরাবর যদি পূনরায় হস্তান্তর হয় তাহলেও দাবীকৃত প্রথম কো—শেয়ারারের অগ্রক্রয় অধিকার বিদ্যমান থাকবে।
কে মামলা করতে পারবে
কৃষি জমির ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার ও সংলগ্ন জমির মালিকদের অগ্রক্রয়ের অধিকার থাকলেও ২০০৬ সালে আইন সংশোধনের মাধ্যমে শুধুমাত্র উত্তরাধিকার সূত্রে যারা সহ শরীক তারাই কেবল এই আইনে অগ্রক্রয়ের মামলা দায়ের করতে পারবেন। একইভাবে অকৃষি জমির ক্ষেত্রে ক্রয়সূত্রে বা অন্যান্য সহ শরীকরা অগ্রক্রয়ের অধিকার প্রদান করেছে। অতএব অকৃষি জমির ক্ষেত্রে ক্রয় সূত্রে বা অন্যান্য সহ শরীকরাও অগ্রক্রয়ের মামলা দায়ের করতে পারবে।
কি ধরনের হস্তান্তরের বিপরীতে অগ্রক্রয় অধিকার বিদ্যমান থাকবে না
জমি বিক্রয় বা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে অগ্রক্রয় অধিকার আইনে স্বীকৃত থাকলেও নিম্নোক্ত হস্তান্তরের বিরুদ্ধে অগ্রক্রয় অধিকার বিদ্যমান থাকবে না। উক্ত ব্যতিক্রম গুলি আলোচনা করা হলো:
- যদি উক্ত ক্রয় বা হস্তান্তর অন্য কোন কো—শেয়ারার এর বরাবর করা হয়।
- হস্তান্তর যদি বিনিময় দলিল বা বন্টননামা দলিলের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়।
- যদি হস্তান্তর হেবা দলিলের মাধ্যমে হয় এবং হেবার মাধ্যমে স্বামী—স্ত্রী অথবা দাতার তিন স্তরের মধ্যে কোন আত্মীয় বরাবর সম্পাদিত হয়।
- বন্ধক দলিলের মাধ্যমে সাময়িক হস্তান্তর হয়।
- যদি ওয়াক্ফ হিসাবে হস্তান্তর হয়।
- ধমীর্য় উদ্দেশ্যে কোন প্রতিষ্ঠান বরাবর হস্তান্তর হয়।
- গ্রহিতা কতৃর্ক দাতা বরাবর পুনরায় হস্তান্তর হয়।
উপরোক্তভাবে যদি কেও হস্তান্তর করে তাহলে উক্ত হস্তান্তরের বিরুদ্ধে অগ্রক্রয় অধিকার কার্যকর হবে না এবং তা আদায়ের জন্য আইনে মোকাদ্দমা দায়ের করা যায় না।
মোকাদ্দমা দায়েরের সময়সীমা
কৃষি জমির ক্ষেত্রে জমি বিক্রয়ের পূর্বে রেজিষ্ট্রেশন আইনের ৮৯ ধারা অনুসারে উত্তরাধীকার সূত্রে শরিকদের নোটিশ দিতে হবে। উক্ত নোটিশ প্রাপ্তির পর থেকে ২ মাসের মধ্যে মামলা করতে হবে। তবে বিক্রেতা যদি নোটিশ গোপন রেখে বিক্রি করে বা প্রি—এম্পেটর নোটিশ সম্পর্কে অবগত না থাকে তবে তার অবগত হওয়ার ২ মাসের মধ্যে মোকাদ্দমা দায়ের করতে হবে। অপরদিকে অকৃষি জমির ক্ষেত্রে ২ মাসের পরিবর্তে ৪ মাসের মধ্যে মোকাদ্দমা দায়ের করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে কৃষি জমির ক্ষেত্রে মোট মূল্য সহ ২৫% হারে ক্ষতিপূরণ টাকা জমা দিয়ে মোকাদ্দমা দায়ের করতে হবে।
লেখক: মো: ফারুক রেজা, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এবং হেড অব চেম্বারস, লিগ্যাল ট্রাষ্ট।