গণভোট, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন প্রণয়নে পদ্ধতিগত ত্রুটি এবং কিছু আইনি প্রশ্ন
মামুন চৌধুরী; অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট

গণভোট, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন প্রণয়নে পদ্ধতিগত ত্রুটি এবং কিছু আইনি প্রশ্ন

মামুন চৌধুরী: সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী সংক্রান্ত বিলটি জাতীয় সংসদে গৃহীত ৩০ জুন২০১১। অতঃপর বিলটি রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য প্রেরণ করা হয়। ৩ জুলাই ২০১১ রাষ্ট্রপতি বিলটিতে সম্মতি প্রদানের পর তা আইনে পরিণত হয় যা পঞ্চদশ সংশোধন আইন ২০১১ (২০১১ সালের ১৪ নং আইন) নামে পরিচিত এবং একই তারিখে আইনটি গেজেটে প্রকাশিত হয়।

সংসদ কর্তৃক আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় কয়েকটি ধাপ রয়েছে। সংবিধানের ৮০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন প্রণয়নের প্রতিটি প্রস্তাব প্রথমে বিল আকারে সংসদে উপস্থাপন করা হয়। বিলের উপর বিভিন্ন ধাপে আলোচনা, পরীক্ষা নিরীক্ষা, চূড়ান্ত বিতর্কের পর বিলটি পাশের জন্য সংসদে ভোট গ্রহণ করা হয়। বিলের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্য ভোট প্রদান করলে বিলটি গৃহীত হয়।

তবে সংবিধান সংশোধন বিষয়ক কোন বিল সংসদে গৃহীত হইতে হইলে মোট সদস্যের দুই তৃতীয়াংশের ভোট প্রয়োজন হয় (অনুচ্ছেদ-১৪২)। অতঃপর সংসদ কর্তৃক গৃহীত বিলটিকে রাষ্ট্রপতির নিকট সম্মতির জন্য পেশ করা হয় এবং রাষ্ট্রপতির সম্মতি প্রদান করলে বিলটি সংসদের আইনে পরিণত হয়। নতুন আইনটি কার্যকর করার জন্য এবং পাবলিক নোটিফিকেশনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে তা গেজেটে প্রকাশিত হয়। জাতীয় সংসদ কর্তৃক কোন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে সাধারণ নিয়ম।

আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সম্মতি একটি আনুষ্ঠানিকতা হিসাবে বিবেচিত হয়, কারণ সংবিধানের ৮০(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি একটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোন বিলে সম্মতি প্রদান না করলে বা সম্মতি প্রদান করতে ব্যর্থ হলে ধরে নেয়া হবে যে রাষ্ট্রপতি বিলটিতে সম্মতি প্রদান করেছেন।

তবে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কার্যকর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সংবিধানের কিছু বিশেষ বিধান যথা- সংবিধানের প্রস্তাবনার, অনুচ্ছেদ ৮ (মৌলিক রাষ্ট্রীয় নীতি)অনুচ্ছেদ ৪৮ (রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত বিধান)অনুচ্ছেদ ৫৬ (প্রধান মন্ত্রী এবং মন্ত্রী সংক্রান্ত বিধান), অনুচ্ছেদ ১৪২ (সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিধান) সংশোধন সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সংসদ কর্তৃক গৃহীত কোন বিলে রাষ্ট্রপতির সম্মতি শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা ছিল নাবরং রাষ্ট্রপতির সম্মতি বা অসম্মতি ছিল একটি বাধ্যতামূলক বিষয় এবং এই সব বিলের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি সম্মতি প্রদান করবেন কি না নির্ভর করতো গণভোটের মাধ্যমে প্রদত্ত জনগণের মতামতের উপর।

আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৭ এ বলা হয়েছে জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক। পঞ্চদশ সংশোধনী আইন ২০১১ কার্যকর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পরিবর্তনের জন্য গৃহীত বিলে রাষ্ট্রপতির সম্মতি প্রদান করবেন কি নাতা নির্ধারণের জন্য অনুচ্ছেদ ১৪২(১ক)(১) অনুযায়ী গণভোটের গ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল। অনুচ্ছেদ ১৪২(১ক)(১) এর মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংশোধনে জনগণের অংশগ্রহণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল এবং প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক যে জনগণ সে বিষয়ে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে গণভোটের বিধান ছিল না।

১৯৭৫ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনীর দ্বারা গণভোটের বিধান সংবিধানে যুক্ত করার মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতাকে স্বীকৃতি প্রদান করেছিলেন। পরবর্তীতে গণভোটের বিষয়ে বিস্তারিত বিধান ও পদ্ধতি প্রণয়নকল্পে জাতীয় সংসদে গণভোট আইন ১৯৯১ (১৯৯১ সনের ২৫ নং আইন) প্রণয়ন করা হয়। ১৯৯১ সালে গণভোট আইন এবং সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর দ্বারা সংবিধানে গণভোট বিধান অন্তর্ভুক্তিকে পুনস্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছিল।

উল্লেখ্য যে ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদের সরকারি ও বিরোধী দলের (বিএনপি, আওয়ামীলীগ, জামাত) সদস্যের সম্মতিতে গণভোট আইন ১৯৯১ এবং সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী বিল পাস হয়েছিল।

ঐতিহাসিকভাবেগণভোট গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পরিবর্তনে জনগণের অংশগ্রহণকে অন্তর্ভুক্ত করে ৷ বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সংবিধান দ্বাদশ সংশোধনী আইন পাশ হওয়ার পূর্বে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ভোটারদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল “রাষ্ট্রপতির কি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) বিল১৯৯১এ সম্মতি দেওয়া উচিত কি না ?” জনগণ হা সূচক রায় প্রদান করেছিল এবং এর ফলে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতির অধীন প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় ৷

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ব্যাপক সংশোধনের পাশাপাশি প্রস্তাবনাসহ মৌলিক রাষ্ট্রীয় নীতি (অনুচ্ছেদ ৮) এবং সাংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিধান (অনুচ্ছেদ ১৪২, ৭খ) সংশোধন করা হয়। ৩ জুলাই২০১১ তারিখে পঞ্চদশ সংশোধন আইন গেজেটে প্রকাশিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সাবেক ১৪২(১ক)(১) অনুচ্ছেদ এবং গণভোট আইন ১৯৯১ অনুযায়ী সংবিধানের প্রস্তাবনারাষ্ট্রীয় নীতি (অনুচ্ছেদ ৮) এবং সাংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিধান (অনুচ্ছেদ ১৪২, ৭খ) এর সংশোধন বিষয়ে তৎকালীন সংসদের একছত্র কোন ক্ষমতা ছিল না কারণ অনুচ্ছেদ ১৪২(১ক)(১) অনুযায়ী সংবিধানের উল্লেখিত বিষয় গুলো সংশোধন করে সংসদ কর্তৃক যে কোন আইন প্রণয়নের জন্য গণভোটের বাধ্যবাধকতা ছিল। এই প্রসঙ্গে সংবিধানের সাবেক অনুচ্ছেদ ১৪২(১ক)(১) এবং গণভোট আইন ১৯৯১ (১৯৯১ সনের ২৫ নং আইন) এর প্রাসঙ্গিক বিধান নিম্নরূপ-

সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ

(১ক) (১) দফায় যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও এই সংবিধানের প্রস্তাবনার অথবা ৮, ৪৮ [বা] ৫৬ [** *) অনুচ্ছেদ অথবা এই অনুচ্ছেদের কোন বিধানাবলীর সংশোধনের ব্যবস্থা রহিয়াছে এইরূপ কোন বিল উপরি-উক্ত উপায়ে গৃহীত হইবার পর সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইলে উপস্থাপনের সাত দিনের মধ্যে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিবেন কি করিবেন না এই প্রশ্নটি গণ-ভোটে প্রেরণের ব্যবস্থা করিবেন।

গণভোট আইন ১৯৯১

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্ত্মাবনার অথবা ৮৪৮৫৬৫৮৮০৯২ক বা ১৪২ অনুচ্ছেদ সংশোধনের ব্যবস্থা করিয়া কোন বিল উক্ত সংবিধানের ১৪২(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদে গৃহীত হইবার পর উহাতে রাষ্ট্রপতি সম্মতিদান করিবেন কি করিবেন না এই প্রশ্নটি যাচাইয়ের জন্য গণভোটের বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত আইন ৷

পঞ্চদশ সংশোধনী বিলটি সংসদে গৃহীত হইবার পর উহাতে রাষ্ট্রপতি সম্মতি প্রদান করিবেন কি না, এই প্রশ্নটি যাচাইয়ের জন্য সংবিধানের ১৪২(১ক)(১) অনুচ্ছেদ এবং গণভোট আইন ১৯৯১ অনুযায়ী গণভোটে প্রেরণ করার বাধ্যবাধকতা থাকা স্বত্বতেও গণভোটে প্রেরণ করা হয় নাই, যদিও  বিচারপতি খাইরুল হক পঞ্চম সংশোধনী মামলার হাই কোর্টের রায়ে গণভোটের বিধান সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ১৪২(১ক)(১) কে অসংবিধানিক ঘোষণা করেন যা আপিল বিভাগ বহাল রাখে।

গণভোট আইন ১৯৯১ এবং দ্বাদশ সংশোধনীর দ্বারা সংবিধানে গণভোটের বিধান অন্তর্ভুক্তিকে যে পুনস্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছিল তা হাই কোর্ট ও আপীল বিভাগের রায়ে বিবেচনা করা হয় নাই, এমনকি গণভোটের বিধানকে কোন যুক্তিতে বাতিল করা হল তারও কোন ব্যাখ্যা কোর্ট ও আপীল বিভাগের রায়ে লক্ষ্য করা যায় না । মূলত গণভোটের বিধান বাতিল সংক্রান্ত হাই কোর্ট ও আপীল বিভাগের রায়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। 

উল্লেখ্য যে, পঞ্চদশ সংশোধন আইন ২০১১ পাশ হওয়ার পূর্বে হাই কোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে  সংবিধান  থেকে গণভোটের বিধান বাতিল করে আনুষ্ঠানিক গেজেট নোটিফিকেশন হয় নাই এমনকি পঞ্চদশ সংশোধন আইন ২০১১ এর ভূমিকায় উল্লেখিত রায় সমূহের কোন রেফারেন্সও নাই ।

এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রশ্ন সামনে আসে তা হচ্ছে (১) পঞ্চদশ সংশোধনী বিলটি সংসদে গৃহীত হইবার পর রাষ্ট্রপতির সম্মতি গ্রহণের পূর্বে সংবিধানের ১৪২(১ক)(১) অনুচ্ছেদ এবং গণভোট আইন ১৯৯১ অনুযায়ী গণভোট না করা একটি গুরুতর পদ্ধতিগত ত্রুটি ছিল কিনা? (২) আইন প্রণয়নে গুরুতর পদ্ধতিগত ত্রুটি কোন আইনকে অবৈধ করবে কিনা ? (৩) পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে পঞ্চদশ সংশোধন আইন ২০১১ সম্পূর্ণই অবৈধ হবে, নাকি শুধু মাত্র প্রস্তাবনা, রাষ্ট্রীয় নীতি (অনুচ্ছেদ ৮) এবং সাংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিধান (অনুচ্ছেদ ১৪২, ৭খ) সংক্রান্ত ধারা গুলো অবৈধ হবে ।

গত ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪ মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ পঞ্চদশ সংশোধনী বিষয়ক একটি রিট মামলায় পঞ্চদশ সংশোধনী আইন ২০১১ এর কিছু কিছু ধারা অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করেছেন। উক্ত রিট মামলার পুরনাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশ হয়নি। আশা করা যায় হাই কোর্টের রায়ে এই আইনগত প্রশ্নগুলোর সমাধান পাওয়া যাবে। 

লেখক: মামুন চৌধুরী; অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট। ই-মেইল: mamun.chowdhury@accordchambers.com