মো. সরোয়ার হোসাইন লাভলু : বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো আইনজীবী সমাজ। তারা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় একদিকে জনগণের পক্ষে কথা বলেন, অন্যদিকে রাষ্ট্র ও বিচারপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে সমর্থন দেন। তবে, বিচারব্যবস্থায় আইনজীবীদের ভূমিকা সত্ত্বেও তাদের পেশাগত সুরক্ষা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে প্রচলিত আইনে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য বিধান নেই।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিল একটি সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে আইনজীবীদের সুরক্ষা ও পেশাগত মানোন্নয়নে কাজ করে আসলেও চ্যালেঞ্জগুলো ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। এই প্রবন্ধে আইনজীবী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা, বার কাউন্সিলের কার্যক্রম, এবং আইনজীবী পেশার উন্নয়নে সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিল: পেশাগত কার্যক্রম ও সীমাবদ্ধতা
সংবিধান ও বার কাউন্সিলের ভূমিকা:
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭(২) এবং ৩১ ধারা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ বার কাউন্সিল অধ্যাদেশ অনুসারে আইনজীবীদের তালিকাভুক্তি, পেশাগত মান উন্নয়ন, এবং শৃঙ্খলা রক্ষায় বার কাউন্সিল কাজ করে থাকে। তবে, এই অধ্যাদেশে আইনজীবী সুরক্ষার বিষয়ে সরাসরি কোনো বিধান নেই।
বার কাউন্সিলের চ্যালেঞ্জসমূহ
১. আইনজীবী তালিকাভুক্তি পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রিতা: পরীক্ষা পদ্ধতি সময়মতো না হওয়ায় আইন পেশায় প্রবেশ বিলম্বিত হয়।
২. পেশাগত আচরণবিধি লঙ্ঘন: কিছু ক্ষেত্রে আইনজীবীদের অনৈতিক কার্যক্রম পেশার সম্মান ক্ষুণ্ন করে।
৩. আর্থিক সহায়তার অভাব: অসহায় বা অসুস্থ আইনজীবীদের জন্য কল্যাণমূলক পদক্ষেপ পর্যাপ্ত নয়।
৪. সুরক্ষা আইনহীনতা: আইনজীবীরা অনেক সময় সামাজিক এবং পেশাগত ঝুঁকির সম্মুখীন হন। কিন্তু তাদের সুরক্ষায় কোনো নির্দিষ্ট আইন নেই।
আইনজীবী সুরক্ষা আইন: প্রয়োজনীয়তা ও কাঠামো
১. প্রয়োজনীয়তা:
আইনজীবীরা মামলার পক্ষ থেকে শারীরিক আক্রমণ, মানসিক চাপ এবং হুমকির শিকার হন। সামাজিক ও পেশাগত মর্যাদা রক্ষায় একটি সুনির্দিষ্ট আইন অপরিহার্য। আদালতের কার্যক্রম নির্বিঘ্ন রাখতে আইনজীবীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।
২. প্রস্তাবিত কাঠামো:
ক। শারীরিক সুরক্ষা: আদালত প্রাঙ্গণ ও শুনানির সময় আইনজীবীদের জন্য নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ।
খ। হুমকি ও হয়রানি রোধ: মামলার পক্ষ থেকে আসা হুমকি প্রমাণিত হলে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।
গ। অর্থনৈতিক সহায়তা: আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত আইনজীবী ও তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান।
ঘ। মানহানির বিচার: আইনজীবীদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্নকারী কাজগুলোকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা।
ঙ। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল: আইনজীবীদের সুরক্ষাসংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন।
সংবিধান ও আইনজীবী সুরক্ষা
প্রাসঙ্গিকতা: সংবিধানের ২৭, ৩১ এবং ৩৫(৩): এসব ধারায় ব্যক্তিগত সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সংরক্ষিত হয়েছে। এই অধিকার আইনজীবীদের জন্যও প্রযোজ্য হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিল অধ্যাদেশ, ১৯৭২: এই অধ্যাদেশের ২১(১) ধারা অনুযায়ী, আইনজীবীদের পেশাগত শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং পেশাগত মানোন্নয়নে বার কাউন্সিল দায়িত্বপ্রাপ্ত। তবে সুরক্ষা বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট বিধান নেই।
উপযুক্ত সংশোধনী প্রস্তাব
বাংলাদেশ বার কাউন্সিল অধ্যাদেশে সংশোধনী এনে আইনজীবীদের সুরক্ষার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
আইনজীবী পেশার উন্নয়নে সুপারিশ
১. পেশাগত প্রশিক্ষণ: আইনজীবীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বার কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত প্রশিক্ষণের আয়োজন।
২. সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ: ডিজিটাল যুগে আইনজীবীদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত তথ্য সুরক্ষায় বিশেষ প্রশিক্ষণ ও আইনি সহায়তা।
৩. সুরক্ষা আইন প্রণয়ন: একটি পৃথক আইনজীবী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষা।
৪. বার কাউন্সিলের কার্যক্রম ডিজিটালাইজড করা: তালিকাভুক্তি থেকে শুরু করে সব কার্যক্রম সহজ ও স্বচ্ছ করতে প্রযুক্তির ব্যবহার।
৫. নির্ধারিত কল্যাণ তহবিল বৃদ্ধি: আইনজীবীদের জন্য কল্যাণ তহবিলের পরিমাণ বাড়ানো এবং এর কার্যকরী ব্যবহার।
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় একটি ‘আইনজীবী সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন সময়ের দাবি। বার কাউন্সিল এবং সরকারের যৌথ উদ্যোগে এই আইনটি বাস্তবায়ন করা হলে তা আইনজীবীদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিচারব্যবস্থার উপর জনগণের আস্থা আরও সুদৃঢ় করবে।
লেখক: অ্যাডভোকেট মো: সরোয়ার হোসাইন লাভলু; অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, চট্টগ্রাম।