মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্ : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি বিশ্বজুড়ে বিপ্লব ঘটিয়েছে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সুবিধা বয়ে এনেছে। তবে, এর অপব্যবহার সাইবার অপরাধের জগতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে, যা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, তথ্য সুরক্ষা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধরনের হুমকি। প্রযুক্তির এ দ্রুত উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কার্যকর আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী এ সমস্যা মোকাবিলায় কী কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে আইনি সীমাবদ্ধতা কীভাবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব, তা গভীরভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
বর্তমান যুগে এআই প্রযুক্তির প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এই প্রযুক্তি শুধু আমাদের জীবনকে সহজতর করেনি, বরং অর্থনীতি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে শিল্প ও বাণিজ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। তবে অপরাধীরা এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে সাইবার অপরাধকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বিশেষত, ফিশিং অ্যাটাক, ভুয়া খবর প্রচার, এবং পরিচয় চুরির মতো অপরাধে এআই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। ডিপফেইক প্রযুক্তি, যা ভুয়া ভিডিও ও অডিও তৈরি করতে সক্ষম, সামাজিক বিভ্রান্তি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
আন্তর্জাতিকভাবে, এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) এআই আইন এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এই আইন এআই ব্যবহারে স্বচ্ছতা এবং নৈতিকতার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষত, এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার হলে কঠোর জরিমানা এবং শাস্তির বিধান রাখার মাধ্যমে এটি একটি শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করেছে। অন্যান্য দেশও এই উদাহরণ অনুসরণ করতে পারে, তবে দেশীয় প্রেক্ষাপট অনুযায়ী তাদের নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লেও, এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট আইন বা নীতিমালা এখনো নেই। বিদ্যমান সাইবার নিরাপত্তা আইন (২০২৩), এআই-চালিত সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত নয়। উদাহরণস্বরূপ, ডিপফেইক বা অ্যালগরিদম দ্বারা সৃষ্ট অপরাধের সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা বা আইনি কাঠামো সাইবার নিরাপত্তা আইনে বিদ্যমান নেই। ফলে অপরাধীরা সহজেই আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে পার পেয়ে যাচ্ছে। দেশের আইনি কাঠামোতে এসব অপরাধকে সুনির্দিষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা, তাদের তদন্ত প্রক্রিয়া নির্ধারণ এবং যথাযথ শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
তবে শুধু আইনি কাঠামো তৈরি করলেই এই সমস্যার সমাধান হবে না। আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন ও জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি এ ক্ষেত্রে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ জনগণ, প্রযুক্তি ব্যবহারকারী, এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করা এবং সঠিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা অপরিহার্য। জনগণ যদি ডিপফেইক বা ভুয়া খবর সনাক্ত করতে পারে, তবে এ ধরনের অপরাধ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সাইবার অপরাধ সাধারণত সীমান্তের বাধা মানে না; অপরাধীরা বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে অপরাধ চালিয়ে যেতে পারে। তাই, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তথ্য বিনিময় এবং অপরাধীদের চিহ্নিত ও শাস্তির জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অনেক সময় অপরাধীরা বিদেশে অবস্থান করে এবং দেশের আইনকে পাশ কাটিয়ে অপরাধ চালিয়ে যায়।
তবে, এআই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার সময় কিছু নৈতিক প্রশ্নও সামনে আসে। আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগের সময় এআই গবেষণা এবং উন্নয়নের সুযোগও নিশ্চিত করতে হবে। মাত্রাতিরিক্ত কঠোর আইন প্রণয়ন করলে এটি প্রযুক্তির বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই, একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি, যেখানে প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধের পাশাপাশি এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য সুপারিশ হলো, প্রথমত, একটি সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা, যেখানে এআই-চালিত অপরাধের সংজ্ঞা এবং শাস্তি সুস্পষ্ট করা থাকবে। দ্বিতীয়ত, একটি বিশেষায়িত প্রযুক্তি নীতি প্রণয়ন করা, যা প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের জন্য আইনি নির্দেশিকা প্রদান করবে। তৃতীয়ত, প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি জাতীয় কর্মসূচি চালু করা, যার মদ্ধে সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। চতুর্থত, একটি বিশেষায়িত সাইবার অপরাধ তদন্ত ইউনিট গঠন করা, যা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে পারবে।
রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এ সমস্যা সমাধানে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখতে পারে। প্রথমত, সরকারের উচিত একটি গবেষণা কমিটি গঠন করা, যা এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের ধরন বিশ্লেষণ করবে এবং প্রয়োজনীয় নীতিমালা তৈরিতে সহায়তা করবে। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তি উদ্ভাবকদের নৈতিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। তৃতীয়ত, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তথ্য বিনিময়ের জন্য একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম গঠন করতে হবে, যাতে সাইবার অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে একটি সুপরিকল্পিত এবং কার্যকর আইন প্রণয়ন করা অপরিহার্য। এর অপব্যবহার রোধে রাষ্ট্র, প্রযুক্তি উদ্ভাবক এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সচেতনতা বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, এবং একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামোই এআই-চালিত সাইবার অপরাধের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে।
লেখক: মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্, সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ল অ্যালায়েন্স (বিএলএ) ইমেইল: ibrahimkhalilullah010@gmail.com