বিচার বিভাগ সংস্কারের দাবি তরুণ বিচারকদের

আদালতে উড়ো চিঠির ছড়াছড়ি, বিব্রত সংক্ষুব্ধ বিচারকরা

ঢাকার অধস্তন আদালতে বিচারকদের বিরুদ্ধে নাম-পরিচয়বিহীন উড়ো চিঠির (বেনামি চিঠি) প্রবাহ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। এসব চিঠিতে সুনির্দিষ্ট তথ্য বা প্রমাণ ছাড়াই বিচারকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, দলবাজি, ঘুষগ্রহণসহ নানা অভিযোগ আনা হচ্ছে। এতে বিচারকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ, অসন্তোষ এবং পেশাগত উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

বিশেষ করে ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এসব উড়ো চিঠির প্রবাহ বাড়ে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই চিঠিগুলো আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই সুপ্রিমকোর্ট এসব অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিচারকদের কাছ থেকে লিখিত ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দিচ্ছে। বিচারকদের মতে, এটি বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতায় মারাত্মক হস্তক্ষেপ।

চিঠির ধরন ও অভিযোগ

সব চিঠির ভাষা ও ধরন প্রায় একইরকম— অভিযোগে কোনো তথ্য বা কাগজপত্র সংযুক্ত নেই। তাতে বিচারকদের ‘দুর্নীতিবাজ’, ‘দলবাজ’, ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর’ এবং ‘ঘুসখোর’ আখ্যা দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা, ২০১৭-এর ৩(১) ধারায় বলা আছে, বেনামি কোনো পত্রকে সাধারণত অগ্রাহ্য করা হবে। তবে তাতে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তার সমর্থনে কাগজপত্র থাকে, তাহলে তা আমলে নেওয়া যেতে পারে।

একটি নির্দিষ্ট ঘটনার বিবরণ

গত ২৭ মার্চ ঢাকার পঞ্চম যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ মো. মামুনুর রহমান সিদ্দিকির বিরুদ্ধে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি উড়ো চিঠি পাঠানো হয়। পাশাপাশি এই চিঠির অনুলিপি প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল, আইন সচিব, ঢাকা জেলা ও মহানগর দায়রা জজসহ সংশ্লিষ্টদের কাছেও পাঠানো হয়।

চিঠিতে অভিযোগ করা হয় যে, বিচারক মামুনুর রহমান সিদ্দিকি পূর্ববর্তী ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের’ আজ্ঞাবহ ছিলেন এবং আইন সচিব ও উপদেষ্টাকে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে ঢাকায় বহাল আছেন।

প্রতিউত্তর চেয়ে চিঠি

এই অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২৩ এপ্রিল সুপ্রিমকোর্টের সহকারী রেজিস্ট্রার (বিচার) এসএম সাদাকাত মাহমুদ বিচারককে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, “আপনার বিরুদ্ধে ঢাকা আইনজীবী সমিতি ও ঢাকা মেট্রোপলিটন আইনজীবী সমিতির সদস্যদের আনীত অভিযোগের বিষয়ে ৫ কার্যদিবসের মধ্যে লিখিত ব্যাখ্যা দাখিল করতে অনুরোধ করা হলো।”

বিচারকদের প্রতিক্রিয়া

ঢাকার একাধিক বিচারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা প্রতিনিয়ত সংবেদনশীল মামলা নিয়ে কাজ করি। এখানে এই ধরনের বেনামি চিঠি আমাদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। এখন প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভয় হয়। এতে স্বাধীন বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।”

আইনজীবী সমিতির অবস্থান

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম বলেন, “আমরাও বিষয়টি শুনেছি। তদন্ত করে দেখা গেছে ‘রুহুল আমিন’ নামে ৫৬ জন আইনজীবী বার অ্যাসোসিয়েশনে আছেন। ৪০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তারা কেউ এই বিষয়ে কিছু জানেন না। বাকিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। ফলে কে এই রুহুল আমিন, সেটাও অজানা।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা সমিতির পক্ষ থেকে একটি রেজুলেশন দিয়েছি— ভবিষ্যতে যেন এমন বেনামি বা উড়ো চিঠি আমলে না নেওয়া হয়।”

জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মন্তব্য

সংগঠনের সভাপতি আমিরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতেই পারে। কিন্তু সেটি যেন সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণসহ আসে। কোনো বেনামি চিঠির ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হলে তা আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর। এসব চিঠিকে আমলে নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।”

সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের মতামত

রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, “কর্তৃপক্ষ চাইলে যেকোনো সময় ব্যাখ্যা চাইতে পারে। তবে শুধু বেনামি অভিযোগের ভিত্তিতে কাউকে শাস্তি দেওয়া উচিত নয়। অভিযোগ প্রমাণ ছাড়া গ্রহণযোগ্য নয়। আগের সরকারের সময় এমন ঘটনার প্রবণতা ছিল। এটা একটা কারণ হতে পারে। কাউকে আটকাতে হলে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ লাগবে। একটা লোককে শাস্তি দিতে হলে তো শুধু অভিযোগ দিলে হবে না; সেটা প্রমাণ করতে হবে।”

তথ্যসূত্র – যুগান্তর