মোঃ ওবাইদুল্যাহ আল মামুন সাকিব : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালে কলকাতার অন্যতম প্রভাবশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল এবং বিশ্ব সমাবৃত নোবেল বিজয়ী এই মহান কবি ১৯৪১ সালে বৃটিশরাজের সময় মৃত্যু বরণ করেন।
কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, গান এমন কোন শাখা নেই সাহিত্যের, যেখানে কবিগুরুর ছোঁয়া লাগেনি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ কবিগুরু নিজেই ছিলেন অনন্য।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সবচেয়ে দুর্বল এবং দুষ্ট ছেলেটিই যে ঠাকুর বাড়ির নাম বিশ্ব দরবারে উঁচু করেছেন সেটা বলতে দ্বিধা নেই। ভারতবর্ষের ইতিহাস, বাংলা সাহিত্য, রাজনৈতিক পটভূমি এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সৃষ্টিতে রবি ঠাকুর অন্যতম সফল ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
সম্প্রতি জাতীয় সংগীত নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। “আমার সোনার বাংলা” কবিতার পটভূমি ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টেবরের বঙ্গভঙ্গ। বৃটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে ১৯০৫ সাল, বাংলা বিহার এবং ওড়িশার জন্য একটি মাইলফলক। বাংলাকে ভাগ করা নিয়ে কলকাতার উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু সম্প্রদায় প্রতিবাদ করে। সেই প্রতিবাদে কবিগুরুও অংশগ্রহণ করেন।
কলকাতার উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভক্তি, প্রতিবাদ এবং বৃটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর রাজা ৫ম জর্জ বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করেন। সেই সাথে বাংলার দুটি প্রদেশ আবারও একীভূত হয়।
এই আন্দোলনে কবিগুরুর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ধর্মীয়, আভিজাত্য এবং রাজনৈতিক স্বার্থে। কিন্তু কবিগুরুর সৃষ্ট সাহিত্য নিয়ে কথা বলা চরম বোকামি। ধর্মীয় স্বাধীনতা, ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত দেয়া কোন সুষ্ঠু রাজনৈতিক আদর্শের ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব না। প্রতিবাদ করার সাহসিকতা থাকলেই রাজনৈতিক শিষ্টাচার প্রকাশ পাবে।
“আমার সোনার বাংলা” কবিতা জাতীয় সংগীত থাকবে কি থাকবে না সেটার জন্য উন্মুক্ত আলোচনা, কবিতার পটভূমি নিয়ে আলোচনা, কবিগুরুর সাহিত্য মনোভাব নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪(১) এ বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সঙ্গীত “আমার সোনার বাংলা”র প্রথম দশ চরণ৷ সাংবিধানিকভাবে, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে এই নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে জাতীয় সংগীত কীভাবে একীভূত হয়েছে সেই বিষয় নিয়েও আলোচনা হতে পারে।
২০২৪ সালের ০৫ই আগস্ট এক অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এদেশের তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে নব রাষ্ট্র কাঠামোর সূচনা হয়েছে। রাষ্ট্রের সংষ্কারে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে একটা গণমূখী সংবিধান প্রণয়ন এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হবে বলে আশাবাদী। কিন্তু একজন সর্বজনীন মহাকবিকে অপমান বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা মানে বাংলা ভাষাকে অপমান করা। এটা কখনোই সমর্থন যোগ্য না।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম এবং বাংলা সাহিত্যে কবিগুরুর অবদান অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য এবং বাংলা ভাষার সম্মৃদ্ধিতে কবির অবদান কী ছিল সেটা আলোচনা করা যেতে পারে। জাতীয় সংগীত রাজনৈতিক আলোচনা সাপেক্ষে পরিবর্তন হবে নাকি থাকবে সেটা এদেশের জনগণই ঠিক করবে৷ প্রয়োজনে একটা গণভোটের আয়োজন হতে পারে।
পৃথিবীর বহু দেশে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গণভোট হয়েছে। এখানেও একটা গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট এই বিপ্লবী সরকার চাইলেই সুষ্ঠুভাবে একটি গণভোটের আয়োজন করতে পারে। তবেই জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।
ধর্মীয় বিশ্বাসে কবিগুরু হিন্দু, তার মানে এই নয় যে, তাকে অপমান, অপদস্ত কিংবা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা যাবে! আমি ব্যক্তিগত ভাবে কবিগুরুর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
বাঙালি, বাংলা সাহিত্য, বাঙালি সংস্কৃতির সাথে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন বাংলা ভাষা এবং বাংলা সাহিত্যের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন কবিগুরুর নাম অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক এবং অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।