মো: সাজ্জাদ হোসেন: বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা, মামলার জট ও ব্যয়বহুলতা দীর্ঘদিন ধরেই সমালোচনার বিষয়। এরই ধারাবাহিকতায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্প্রতি প্রণীত নতুন অধ্যাদেশের মাধ্যমে সিভিল প্রসিডিউর কোড, ১৯০৮-এ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারা ও আদেশের সংশোধনী আনা হয়েছে। এই সংশোধনীগুলো বিচারব্যবস্থাকে আরও দক্ষ, স্বচ্ছ ও আধুনিক প্রযুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করতে সহায়ক হবে। নিম্নে এই সংশোধনীর মূল ধারাগুলো বিশ্লেষণ করা হলো:
মিথ্যা এবং বিরক্তিকর মামলার ক্ষেত্রে দন্ডমূলক খরচ বৃদ্ধি
আগে মামলা-মোকদ্দমা অপ্রয়োজনে দায়ের করে হয়রানি করলে আদালত সর্বোচ্চ ২০,০০০/- টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারত। নতুন সংশোধনের মাধ্যমে আদালত ৫০,০০০/- টাকা ক্ষতিপূরনের আদেশ দিতে পারবেন। এর মাধ্যমে মিথ্যা এবং বিরক্তিকর মামলার পরিমান কমে অকারনে হয়রানি প্রতিরোধে সহায়ক হবে।
সমন জারিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির সংযোজন
অর্ডার ৫-এর রুল ৯(৩)-এ ডকুমেন্ট বা সমন প্রেরণের পদ্ধতিতে “Short Message Service (SMS), Voice Calls, Instant Messaging Services”প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। এটির মাধ্যমে এখন থেকে এসএমএস, ভয়েসকল, ইন্সট্যান্ট মেসেজিং সার্ভিসের মাধ্যমে সমন বা নোটিশ পাঠানো যাবে। এর মাধ্যমে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ডিজিটাল প্রযুক্তিকে আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া দিয়েছে, যা দ্রত ও সহজে সমন প্রেরণে ভূমিকা রাখবে।
মামলার বাদী ও বিবাদীর পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংযোজন
অর্ডার ৭-এর রুল ১(খ) ও (গ)-এ বাদী ও বিবাদীর নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর (এনআইডি) এবং ইমেইল ঠিকানা (যদি থাকে) উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটি পক্ষগুলোর সঠিক পরিচয় নিশ্চিত করে মামলার কার্যক্রমকে আরও স্বচ্ছ ও তরান্বিত করবে।
একাধিকবার ডিক্রি বাতিলের সুযোগ রোধ
অর্ডার ৯-এর, রুল ১৩ এ নতুনসাবরুল ১৩(১) প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। উক্ত সাব রুল সংশোধন করে বলা হয়েছে, কোনো বিবাদী একই মামলায় একাধিকবার ডিক্রি বাতিলের আবেদন করতে পারবে না। এর ফলে মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমবে।
আদালত কর্তৃক সময় মঞ্জুর করার ক্ষমতা সীমিতকরণ
অর্ডার ১৭-এর, রুল ১ এর সাব-রুল ১(৩) অনুযায়ী আগে পক্ষদ্বয়ের আবেদনে মূল শুনানীর পূর্বে আদালত চাইলে ৬ বার শুনানী মুলতবীর আদেশ দিতে পারতেন। নতুন সংশোধনীর মাধ্যমে আদালত এখন থেকে ৪ বারের বেশি মুলতবীর আদেশ মঞ্জুর করবেনা।
সাক্ষ্য প্রক্রিয়া সহজীকরণ
অর্ডার ১৮-এ সাব-রুল ৪(এ) নতুন যুক্ত করে বাদী বা বিবাদীর লিখিত বক্তব্য ও দলিলাদি হলফনামার মাধ্যমে জমা দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এতে সাক্ষ্য প্রক্রিয়া দ্রুততর হবে এবং আদালতের সময় সাশ্রয় হবে।
ডিক্রি কার্যকর করার নতুন পদ্ধতি
টাকা আদায়ের মোকদ্দমায় ডিক্রি জারীর ক্ষেত্রে অর্ডার ২১-এ সাব-রুল ৩০(এ) সংযুক্ত করে দেওয়ানি আদালতের ডিক্রিকে জরিমানা আদায়ের পদ্ধতিতে কার্যকর করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া, জাজমেন্ট-ডেবটর আটক থাকাকালীন সময়ে ডিক্রীকৃত টাকার ২৫% জমা প্রদান এবং বাকী অর্থ পরিশোধের জন্য ৬০ দিনের মধ্যে বন্ড জমা দেয় তাহলে আদালত তাকে মুক্তি দিবে। তবে নাবালক, মানসিকভাবে অস্থির ব্যক্তি বা যাকে আদলত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষণা করেছে এবং যারা উত্তরাধিকার সূত্রে মুল জাজমেন্ট-ডেবটরের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে এদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না।
স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ডিক্রি সরাসরি কার্যকরের প্রক্রিয়া
অর্ডার ২১-এর সাব-রুল ১০৪ যুক্ত করে স্থাবর সম্পত্তির জমির ডিক্রি কার্যকর করার জন্য সরাসরি ডিক্রিধারীকে দখল দেওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ডিক্রির পরও যদি বিবাদী সম্পত্তি বুঝিয়ে না দেয়, তাহলে আদালত প্রয়োজনে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সহায়তায় ডিক্রি বাস্তবায়ন করতে পারবে।
আপিল প্রক্রিয়া সহজীকরণ
অর্ডার ৪১-এর সংশোধনে, কোনো আপিল একবারের বেশি পুনঃশুনানি হবে না এবং মামলার নিষ্পত্তির জন্য আদালতের আরো বেশি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
মন্তব্য
Code of Civil Procedure (Amendment) Ordinance, 2025 বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এতে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে, মামলার জট কমবে এবং প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে এই পরিবর্তনগুলো সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের প্রশিক্ষণ এবং উপযুক্ত অবকাঠামো নিশ্চিত করা অপরিহার্য। সংশোধিত বিধানাবলি কার্যকর হলে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা আরও স্বচ্ছ, দক্ষ ও নাগরিকবান্ধব হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা।