রাশিদা চৌধুরী : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, এক সময়ের কল্পকাহিনির চরিত্র, আজ আমাদের বাস্তবতার নিরব সঙ্গী। যে যন্ত্র একদিন ছিল মানুষের হাতের তৈরি নিছক যান্ত্রিকতা, সে আজ যেন হয়ে উঠেছে চিন্তাশীল, বিশ্লেষক, এমনকি সিদ্ধান্তগ্রাহী এক নতুন ‘সত্তা’। এই প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা যেন সময়ের চেয়েও দ্রুত, আর সেই গতির স্রোতে ভেসে যাচ্ছে আমাদের চেনা সমাজ, কাজের ধরন, এমনকি নৈতিকতার সংজ্ঞাও।
যান্ত্রিকতা যখন বুদ্ধির অনুকরণ শুরু করে, তখন প্রশ্ন ওঠে, এই বুদ্ধি কি নিছক গাণিতিক বিশ্লেষণ, নাকি এতে রয়েছে কিছু মানবিক বোধও? প্রযুক্তির উন্নয়নকে কীভাবে ব্যবহার করা হবে!! সেবায় নাকি শোষণে, ত্যাগে নাকি দখলে। এই সিদ্ধান্তই ভবিষ্যতের মানবসমাজকে কোথায় দাঁড় করাবে তা নির্ধারণ করবে।
বিশ্ব আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ে এক মহাযজ্ঞে মেতে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক দেশ এ প্রযুক্তির আইনগত কাঠামো নির্মাণে ব্যস্ত। কারণ তারা বুঝেছে, AI (Artificial Intelligence) শুধুমাত্র প্রযুক্তি নয়, এটি একটি শক্তি। যা সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলতে সক্ষম। কিন্তু সেই প্রভাব যদি অপ্রত্যাশিত হয়, যদি তার ফলে মানবিকতা হারিয়ে যায়, তবে সে প্রযুক্তির জয়গান নয়। তা হবে সভ্যতার করুণ আত্মসমর্পণ।
আমরাও পিছিয়ে নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশের পদচারণা পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নপূরণে এই প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হচ্ছে নীতিমালা, কৌশল ও পরিকল্পনা। ২০২০ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ “জাতীয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কৌশল” প্রণয়ন করে, যেখানে অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি এবং প্রশাসনসহ বিভিন্ন খাতে AI এর ব্যবহারের রূপরেখা তৈরি করা হয়। কিন্তু বাস্তবায়নের পথে রয়েছে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ। আইনগত কাঠামোর অভাব, দক্ষ জনবলের সংকট, এবং গোপনীয়তা রক্ষার সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
এই প্রযুক্তির ক্ষমতা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি তা ভীতিকরও। AI-এর মাধ্যমে এখন মানুষ ভুলে যেতে পারে নিজের চিন্তা, নিজের অনুভব, এমনকি নিজের পরিচয়। Facebook-এ আপনি কী পড়বেন, YouTube-এ কী দেখবেন, কিংবা Google-এ কী খুঁজবেন, সবকিছুই নির্ধারিত হচ্ছে এক অদৃশ্য AI এর মাধ্যমে, যাকে আপনি চিনেন না, জানেন না, বুঝতেও পারেন না। এই অদৃশ্য সিদ্ধান্তগ্রাহী ব্যবস্থার পেছনে যেহেতু কোনো মানবিক বিবেক নেই, তাই সেখানে পক্ষপাত, গোপনীয়তা লঙ্ঘন কিংবা বৈষম্যের সম্ভাবনা থেকেই যায়। আর এসব নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন হয় শক্তিশালী, সুস্পষ্ট এবং বাস্তবায়নযোগ্য আইন।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে দেখা যায় যে AI ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আইন ও নীতিমালার গুরুত্ব কী পরিমাণে বিবেচনা করা হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের AI Act-এর মাধ্যমে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবস্থাকে আলাদা শ্রেণিভুক্ত করে নির্দিষ্ট নীতিমালায় বেঁধে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নির্বাহী আদেশ জারি করে AI নির্মাতা ও ব্যবহারকারীদের ওপর দায়িত্ব চাপিয়েছে। চীন অ্যালগরিদমের ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণে এনেছে, যেন তা রাষ্ট্রবিরোধী বা সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরিতে ব্যবহার না হয়। ইউনেস্কো AI এর জন্য একটি নৈতিক নির্দেশিকা দিয়েছে, যেখানে মানবাধিকার, বৈষম্যহীনতা এবং জবাবদিহিতার কথা বলা হয়েছে।
আমাদের দেশে এখনো এ ধরণের কোনো পূর্ণাঙ্গ আইন নেই। ফলে, AI ব্যবহারে কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করা কঠিন। এমনকি AI ব্যবস্থার কোনো অনৈতিক বা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী কে হবে, তাও স্পষ্ট নয়। ফলে প্রযুক্তির উন্নয়ন যেমন চলছে, তেমনি তৈরি হচ্ছে এক অনিয়ন্ত্রিত শক্তির আশঙ্কা। একদিকে আমাদের দরকার এই প্রযুক্তিকে দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনসেবা উন্নত করা, অন্যদিকে এটি যেন মানবাধিকার লঙ্ঘন না করে, সে বিষয়েও নিশ্চিত হতে হবে।
উন্নয়নশীল দেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো; প্রযুক্তিকে গ্রহণের আগেই তার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। অনেক সময় উন্নয়ন আগে আসে, নীতিমালা পরে; আর তখনই শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। AI যদি আগে প্রবেশ করে, আর আইন যদি আসে তার পেছনে দৌড়ে, তবে নিয়ন্ত্রণ নয়। বরং প্রতিকারই হয়ে উঠবে কঠিন।
তাই বাংলাদেশে “বাংলাদেশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আইন ২০২৫” নামে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। এই আইনে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। AI ব্যবস্থার নিবন্ধন, অপারেশনাল লাইসেন্সিং, প্রাইভেসি নীতিমালা, নৈতিক ব্যবস্থাপনা, পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্তের প্রতিকার ব্যবস্থা এবং ক্ষতিপূরণ দাবি করার সুযোগ। প্রযুক্তি যেন মানুষের মিত্র হয়ে থাকে। এই চেতনা থেকেই তৈরি হতে হবে এই আইন।
এই আইন বাস্তবায়নের জন্য একটি স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী সংস্থা “বাংলাদেশ AI কমিশন” গঠন করা যেতে পারে। এই কমিশন হবে নীতিমালা প্রণয়ন, অনুমোদন, তত্ত্বাবধান এবং গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু। AI ব্যবহারের ঝুঁকি মূল্যায়ন, মডেল যাচাই, জনসচেতনতা সৃষ্টি ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রক্ষা। এসব দায়িত্বও তাদের কাঁধে থাকবে। এই সংস্থা যেন হয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত এবং দক্ষ প্রযুক্তিবিদ ও আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত।
AI এর দুনিয়ায় সবচেয়ে আলোচিত যে বিষয়টি, তা হলো- Explainability অর্থাৎ একটি AI সিদ্ধান্ত কেন এবং কীভাবে নিল, তা যদি ব্যবহারকারী বুঝতে না পারে, তাহলে তা হয়ে পড়ে এক ধরণের অন্ধ বিশ্বাস। এই অন্ধ প্রযুক্তির হাতে জীবন পরিচালনার ভার দিলে সভ্যতা নিজের আত্মপরিচয় হারায়। তাই আইনগতভাবে নিশ্চিত করতে হবে, প্রতিটি AI ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত যেন ব্যবহারকারী বুঝতে পারে, এবং প্রয়োজনে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
সামাজিক দিক থেকেও AI এক গভীর দাগ ফেলছে। গার্মেন্টস খাতে স্বয়ংক্রিয় মেশিন, কাস্টমার কেয়ারে চ্যাটবট, শিক্ষায় স্বয়ংক্রিয় মূল্যায়ন। এসবই মানুষের চাকরি কেড়ে নিচ্ছে। অথচ আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ এই ধরনের প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত নয়। ফলে প্রযুক্তি যেমন এগোচ্ছে, তেমনি বাড়ছে কর্মহীনতার আশঙ্কা। এই বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিকও। এমন পরিস্থিতিতে আইনের মাধ্যমে প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতা ও ব্যবহারযোগ্যতার সীমা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
অপর দিকে AI দিয়ে এখন তৈরি হচ্ছে ডিপফেইক ভিডিও, মিথ্যা তথ্য ও প্রোপাগান্ডা। এর ফলে সমাজে বিভ্রান্তি, চরিত্র হনন এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব মোকাবেলায় শুধুমাত্র ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নয়। AI নির্ভর সিদ্ধান্ত এবং কনটেন্টের পৃথক আইন প্রয়োজন।
ব্যক্তিগত ডেটার সুরক্ষা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের প্রতিটি অনলাইন ব্যবহার, সার্চ হিস্টোরি, মুখাবয়ব, কণ্ঠস্বর, এমনকি অনুভবের প্রকাশও এখন ডেটার রূপে সংরক্ষিত হচ্ছে এবং তা AI দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব তথ্য যাতে অন্যায়ভাবে সংগ্রহ বা বিক্রি না হয়, সে জন্য প্রয়োজন কঠোর তথ্য সুরক্ষা আইন। ইউরোপে যেমন GDPR রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও চাই একটি শক্তিশালী ডেটা প্রোটেকশন আইন।
AI বিষয়ক শিক্ষা এবং জনসচেতনতা তৈরি করাও এই আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হতে পারে। আজকের শিক্ষার্থীরা আগামী দিনের AI ব্যবহারকারী, প্রশিক্ষক কিংবা নীতিনির্ধারক। তাই তাদের জন্য স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে AI ও নৈতিক প্রযুক্তি বিষয়ক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শুধু প্রযুক্তি শিক্ষা নয়, নৈতিকতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় থাকলে প্রযুক্তির ব্যবহার হবে কল্যাণমুখী।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্বও এখানে অস্বীকার করা যায় না। একটি দেশের একক প্রচেষ্টায় AI প্রযুক্তির নৈতিকতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই জাতিসংঘের আওতায় একটি “বৈশ্বিক AI চুক্তি” হওয়া উচিত, যেখানে মানবাধিকার, গোপনীয়তা, এবং নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত থাকবে। AI ব্যবহারের আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণ এবং লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে শাস্তি ও প্রতিকারব্যবস্থা থাকতে হবে।
এই প্রযুক্তির হাত ধরে আমরা প্রবেশ করছি এক নতুন সভ্যতায়। যেখানে মানুষ ও যন্ত্রের সহাবস্থান ঘটছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু সেই সহাবস্থান যেন হয় মানবিক ও ন্যায্য, সে জন্য প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও আইন। প্রযুক্তি যদি মানুষের হৃদয় ভুলে যায়, তবে সে আর উন্নয়ন নয়। তা হয়ে পড়ে এক শোষক ব্যবস্থার নামান্তর। আইনই হবে সেই সীমানার রেখা, যা প্রযুক্তিকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করবে।
সর্বপরি বলবো, আমাদের অগ্রগতির সঙ্গী হোক, কিন্তু যেন তা আমাদের মানবতা কেড়ে না নেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।” আমরা যেন সেই বিশ্বাস রক্ষা করতে পারি। প্রযুক্তির পেছনে থাকা যন্ত্র যেন মনুষ্যত্বের অলিখিত নিয়মকে অমান্য না করে। AI যেন হয় আমাদের সহযাত্রী; not master, but ally.
লেখক : রাশিদা চৌধুরী; আইনজীবী, আপিল বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। ই-মেইল: rasida.chowdhury@gmail.com