মাসুদুর রহমান : বর্তমান বিশ্বে, প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম (social media) হয়ে উঠেছে জনগণের অন্যতম প্রধান যোগাযোগের মাধ্যম। বাংলাদেশেও Facebook, YouTube, Twitter, TikTok, WhatsApp ইত্যাদির মাধ্যমে নাগরিকরা নিজেদের মতামত প্রকাশ করে এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও আইনি বিষয়ে জনমত গঠন করে। এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গঠিত জনমত কখনো কখনো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নের সম্মুখীন করে।
যদিও বাংলাদেশের বিচারপতিরা সংবিধান দ্বারা স্বাধীন (বাংলাদেশ সংবিধান, অনুচ্ছেদ ৯৪(৪), তবুও বিচারাধীন মামলায় প্রচারিত তথ্য, জনমতের চাপ এবং মিডিয়া ট্রায়াল আদালতের পরিবেশকে প্রভাবিত করে। বিচারিক সিদ্ধান্ত সাধারণত সাক্ষ্যপ্রমাণ ও আইনি ব্যাখ্যার ওপর নির্ভরশীল হলেও, জনমতের একটি অদৃশ্য চাপ থেকে বিচারকরা সম্পূর্ণ মুক্ত নন। John Rawls-এর “Theory of Justice”-এ বলা হয়েছে যে, “যেখানে জনগণের ন্যায়ের বোধ প্রবল, সেখানে বিচার ব্যবস্থাও সে বোধকে প্রতিফলিত করে।”
যখন ন্যায়বিচারের কণ্ঠস্বর সোশ্যাল মিডিয়ার কোলাহলে হারিয়ে যায়
“ন্যায়বিচার অন্ধ হলেও, আজকাল তার চোখে সোশ্যাল মিডিয়ার আলো জ্বলে ওঠে।” এ বাক্যটি এখন কেবল সাহিত্যিক রূপক নয় বরং একটি ভয়ঙ্কর বাস্তবতা।
বাংলাদেশের আদালতগুচ্ছে প্রতিদিন অসংখ্য বিচারক জীবনের নানা জটিল সুতোর গিট খুলতে বসেন। তারা সংবিধানের শপথে বলীয়ান হয়ে আইন ও সাক্ষ্য অনুযায়ী রায় দেন। কিন্তু যখন ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আগেই আসামিকে অপরাধী বা নির্দোষ ঘোষণা করা হয়—তখন বিচারকের মানসিক স্বাধীনতাও নড়বড়ে হয়ে যায়। বিচারকের টেবিলের ওপরে যে ফাইলটি রাখা, সেটি যেমন সত্যের দলিল বহন করে, তেমনি তাঁদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ফোনের পর্দায় চলমান ‘জনগণের রায়’—তাও এক বাস্তবতার ভার বহন করে।অধিকাংশ বিচারকই চান আইন ও প্রমাণের ভিত্তিতে রায় দিতে। কিন্তু যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো হত্যা, ধর্ষণ বা দুর্নীতির ঘটনা ভাইরাল হয়, তখন জনমতের এক ধ্বনি ওঠে—“এই খুনি/ধর্ষককের ফাঁসি চাই!” এই ধ্বনি যেন আদালতের দেয়াল ভেদ করে বিচারকের অন্তঃকরণে পৌঁছে যায়।
মামলার আলোকে বিচারিক সিদ্ধান্তে সোশ্যাল মিডিয়ার অনুপ্রবেশ
রিফাত শরীফ হত্যা মামলা (State vs Minni and Others, 2020)
রিফাত শরীফকে দিনে-দুপুরে স্ত্রীর সামনে কুপিয়ে হত্যা করার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে। দেশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। জনগণ আর আইনগত প্রক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে পারেনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘Minni খুনি’—এই রায় আগেই দিয়ে ফেলে মানুষ। সরকার দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া চালু করলো। বিচারক স্বল্প সময়ের মধ্যে রায় দিলেন—মৃত্যুদণ্ড।
প্রশ্ন থেকে যায় বিচারক আইন মেনেই রায় দিয়েছেন—তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই গতি, এই জনচাপ কি তাঁকে প্রভাবিত করেনি?
নুসরাত জাহান হত্যা মামলা (State vs Siraj-ud-Daula and Others, 2019)
নুসরাতের শরীর পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার মুখে সাহসের আগুন জ্বলেছিল। তার ভিডিও, মৃত্যুশয্যায় দেওয়া বক্তব্য ভাইরাল হলো সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফেসবুক থেকে মানুষের কান্না courtroom-এর দেয়ালেও গড়িয়ে এলো। বিচারক ৬১ কার্যদিবসে রায় দিলেন। ১৬ জন আসামির মৃত্যুদণ্ড। বিচারপ্রক্রিয়ার দ্রুততা এবং সর্বোচ্চ শাস্তির রায় সামাজিক চাপ ও জনমতের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিফলন ছিল।
বিচারকের পদত্যাগ: ICT ট্রাইব্যুনাল ও “Skypegate”
২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার ঘিরে শাহবাগ আন্দোলন দানা বাঁধে। সোশ্যাল মিডিয়ায় যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি ওঠে। এই সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ কথোপকথন ফাঁস করে এক বিদেশি সংবাদমাধ্যম। আদালতের আভ্যন্তরীণ আলোচনা ফেসবুকে ভাইরাল হয়। বিচারপতি পদত্যাগে বাধ্য হন। এটা শুধু এক ব্যক্তির পদত্যাগ নয়—এটা ছিল বিচারিক গোপনীয়তা ও নিরপেক্ষতার এক ভয়ংকর পরাজয়।
গুজব, বিভ্রান্তি ও বিচারকের সিদ্ধান্তে প্রভাব
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই গুজব ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে আলোচিত মামলায়। মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য বিচারকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে।
পরীমনি বনাম নাসির উদ্দিন মাহমুদ মামলা (2021)
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত বিভিন্ন ভিডিও ও স্ট্যাটাস আদালতে উপস্থাপন করা হয়। কিছু ভিডিও ও তথ্য বিভ্রান্তিকর ছিল, যার সত্যতা যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়ে। বিচারককে শুধু সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত দিতে হলেও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তীব্র প্রচার বিচারকদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করে। সোশ্যাল মিডিয়া সত্য-মিথ্যার বিচার করে না, তার বিচার একটাই—“কতটা ভাইরাল?”কিন্তু বিচারকের কাজ—“কতটা প্রমাণযোগ্য?” এই দুইয়ের টানাপোড়েনে যে ন্যায়বিচার জর্জরিত হয়, তা আর কেউ বোঝে না—শুধু একজন একাকী বিচারক ছাড়া।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের উদ্যোগ
২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট একটি Practice Direction জারি করে, যেখানে বিচারাধীন মামলার বিষয়ে মিডিয়াতে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
২০১৯ সালের একটি রুলিংয়ে, হাইকোর্ট Division বলেছে, “Social media discussions must not prejudice pending court matters.” (Writ Petition No. 4832/2019)
আন্তর্জাতিক তুলনা
ভারত
• ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট (Sahara India Real Estate Corp v. SEBI, 2012) বলেছে— বিচারাধীন মামলায় মিডিয়া ট্রায়াল ন্যায়বিচারের সম্ভাবনাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে।
যুক্তরাজ্য
• Contempt of Court Act, 1981 অনুযায়ী, বিচারাধীন মামলার বিষয়ে প্রকাশ্য মন্তব্য আদালত অবমাননার আওতায় পড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র
• Sheppard v. Maxwell, 384 U.S. 333 (1966): আদালত সিদ্ধান্ত দেয় যে ব্যাপক মিডিয়া প্রচার ন্যায়বিচার ব্যাহত করতে পারে এবং বিচারকের দায়িত্ব হলো, নিরপেক্ষ বিচারিক পরিবেশ নিশ্চিত করা।
ন্যায়বিচারের স্বাধীনতা রক্ষায় করণীয়
- Social Media Code of Conduct for Judges: আদালতের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন।
- Media Ethics Law Reform: বিচারাধীন বিষয় নিয়ে সংবাদ/পোস্টে নিয়ন্ত্রণ।
- Cyber Forensics in Courts: ডিজিটাল প্রমাণ যাচাইয়ে বিশেষজ্ঞ ইউনিট।
- Training for Judges & Lawyers: মিডিয়া হ্যান্ডলিং ও মানসিক চাপ মোকাবেলায় প্রশিক্ষণ।
ন্যায়বিচারের একাকী যোদ্ধাদের রক্ষা করতে হবে
একজন বিচারক তার চেম্বারে বসে আইনের বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টান। তার সামনে পড়ে থাকা প্রমাণ আর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা আবেগঘন স্ট্যাটাস, শেয়ার, ভিডিও—এই দুইয়ের মাঝে এক অদৃশ্য লড়াই চলে। তাঁকে আইন অনুযায়ী রায় দিতে হয়, কিন্তু তিনি মানুষ—তিনি অনুভব করেন চারপাশের চাহিদা, ক্রোধ, আশা।আমরা যদি সত্যিকারের ন্যায়বিচার চাই, তাহলে বিচারকের হাতকে মুক্ত রাখতে হবে—সোশ্যাল মিডিয়ার ‘ডিজিটাল রশি’ থেকে।
পরিশেষে বলতে পারি যে, বিচার একটি সাধনা, যেখানে সত্য ও মিথ্যার মাঝে দাঁড়িয়ে একজন বিচারক আইন, বিবেক ও প্রমাণের আলোয় রায় প্রদান করেন। কিন্তু এই স্নিগ্ধ আলো এখন ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তীব্র চাপে, আবেগঘন জনতার রোষে এবং ভাইরাল সংস্কৃতির ঝড়ে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগ যখন জনমানুষের শেষ আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়, তখন বিচারিক স্বাধীনতার পরিপূর্ণতা নিশ্চিত করা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই স্বাধীনতাই বিচারব্যবস্থার ভিত্তি।
অথচ আজকাল, যেকোনো আলোচিত মামলার রায় আদালতে আসার আগেই ফেসবুক স্ট্যাটাসে, ইউটিউব লাইভে এবং টিকটকের রঙিন ভিডিওতে ঘোষিত হয়ে যায়। বিচারাধীন বিষয়ে জনতার এই স্বঘোষিত রায় বিচারকদের ওপর এক মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করে, যার প্রভাব কখনো সরাসরি, কখনো পরোক্ষভাবে বিচারের উপর এসে পড়ে। এই অবস্থা শুধু বিচারকের পেশাগত দায়িত্বের পরিপন্থী নয়, এটি পুরো বিচারব্যবস্থার উপর এক সূক্ষ্ম কিন্তু গভীর আঘাত।
বিচারকও মানুষ। তিনি সামাজিক বাস্তবতায় বাস করেন, মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া তথ্য, মুখর জনগণের চাহিদা, কিংবা সরকার বা বিরোধীদলের চাপ—সবই তাঁর চারপাশে ঘোরে। কিন্তু এসব কিছু পাশ কাটিয়ে তিনি যখন একটি রায় লিখতে বসেন, তখন তাঁর একমাত্র সহচর হওয়া উচিত সংবিধান, আইনের ধারা, এবং মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ।
লেখক : আইনজীবী ; বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।