মো. রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী
মো. রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী

সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫: বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নতুন দিগন্ত

৩০ নভেম্বর ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছেন। নিঃসন্দেহে, এটি বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ও কাঙ্ক্ষিত সংস্কার।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ক, দাবি এবং বিশেষত মাসদার হোসেন মামলার আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই অধ্যাদেশ একটি নতুন বাস্তবতার দ্বার খুলে দিয়েছে। সংবিধানের ২২, ১০৯ ও ১১৬ অনুচ্ছেদে পৃথকীকরণ, তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের নীতি সুস্পষ্ট হলেও বাস্তবে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব পুরোপুরি দূর করা সম্ভব হয়নি, ফলে কাঠামোগত উন্নয়নও দীর্ঘদিন থমকে ছিল। নতুন অধ্যাদেশ সেই স্থবিরতা কাটিয়ে বহুল প্রত্যাশিত প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের পথ তৈরি করেছে।

অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির অধীন একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মাধ্যমে অধস্তন আদালতের তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলাবিধান, জুডিশিয়াল সার্ভিসের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত এখন থেকে নির্বাহী বিভাগের পরিবর্তে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের আওতায় আসবে। এতে নির্বাহী হস্তক্ষেপের অবসান ঘটবে এবং বিচার বিভাগ প্রকৃত অর্থেই স্বাধীনভাবে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে পারবে।

আরও পড়ুনসুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ জারি, নির্বাহী বিভাগ থেকে পুরোপুরি পৃথক হলো বিচার বিভাগ

এছাড়াও মাননীয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত “সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় কমিশন” বিচার প্রশাসনের উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি ও কাঠামোগত সংস্কারে নীতিগত দিকনির্দেশনা প্রদান করবে। ফলে বিচার ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ সংস্কার আরও গতিশীল হবে।

এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে সাংবিধানিক বাস্তবায়ন ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে; অনুচ্ছেদ ২২ এর রাষ্ট্রের সকল অঙ্গের স্বাধীনতা ও পৃথকীকরণ, অনুচ্ছেদ ১০৯: অধস্তন আদালতের উপর উচ্চ আদালতের তত্ত্বাবধান এবং অনুচ্ছেদ ১১৬: বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা। একই সঙ্গে মাসদার হোসেন মামলার ঐতিহাসিক রায় বাস্তবায়নের পথে এটি নিঃসন্দেহে এক মাইলফলক। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার দীর্ঘদিনের দাবি এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তব রূপ পেয়েছে।

স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পরও কিছু বাস্তব চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে; সচিবালয়ের সার্বিকভাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা । প্রশাসনিক কাঠামোর পরিবর্তন বাস্তবে কার্যকর করতে সময় প্রয়োজন। নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সমন্বয় বজায় রাখা। এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকা।

‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মর্যাদা ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়। এটি কেবল প্রশাসনিক সংস্কার নয়, বরং বিচারপ্রার্থী নাগরিকের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকারকে আরও শক্তিশালী করার অগ্রযাত্রা। তবে এর সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করবে সচিবালয়ের দক্ষ পরিচালনা, স্বচ্ছতা, এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকার উপর।

লেখক : মোঃ রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী; অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন আদালত।