সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়

যেভাবে চলবে স্বতন্ত্র সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়

৫৩ বছর আগে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং ২৬ বছর আগের দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরেও বাস্তবায়িত হয়নি নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ ‘পৃথকীকরণ’। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর এবার সব কিছু পেছনে পেলে ৫৩ বছরের সেই কাঙ্ক্ষিত গেজেট প্রকাশ করেছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার।

তবে এটি বাস্তবায়নে সব সময় তাগিদের ওপর রেখেছিলেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। ৩০ নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথককরণের উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার অধ্যাদেশ জারি করা হয়। সেই গেজেট জারির পর শুভকামনা জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের দুইজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।

আর সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন বলছে, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিবাচক সহযোগিতায় বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আজ বাস্তবরূপ নিল।

অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য

অধস্তন আদালতের তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধান সংক্রান্ত বিষয়াদি যথাযথরূপে পালনের জন্য এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় বিধান প্রণয়নকল্পে এই অধ্যাদেশ প্রণীত হয়েছে। অধ্যাদেশে সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ, ১০৯ অনুচ্ছেদ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ এবং মাসদার হোসেন মামলার রায়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

যেভাবে চলবে হবে সচিবালয়

অধ্যাদেশের ১ এর ২ উপধারায় বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় স্থাপন ও কার্যক্রমে পূর্ণরূপে চালু হওয়া সাপেক্ষে সরকার সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে ধারা-৭ এর বিধানাবলী সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা কার্যকরও করবে।

ধারা ৭ এ বলা হয়েছে, (১) সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় সার্ভিস প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হবে। (২) সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় সার্ভিস সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধান সংক্রান্ত কাজে রাষ্ট্রপতির পক্ষে প্রয়োজনীয় সব প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করবে।

(৩) সার্ভিস সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধান সংক্রান্ত কার্যাদি সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সচিব কর্তৃক সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট কমিটির পরামর্শের জন্য উপস্থাপিত হবে। (৪) উপ-ধারা (৩)-এ উল্লিখিত কমিটির সদস্যরা নির্ধারিত পদ্ধতিতে আপিল বিভাগের বিচারকগণ কর্তৃক মনোনীত হবেন।

(৫) উপ-ধারা (২)-এর বিধান সত্ত্বেও, আইন ও বিচার বিভাগ ও এর কার্যপরিধিতে বর্ণিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা এবং অন্য কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষের দপ্তরে সার্ভিস সদস্যগণের পদায়ন বা বদলি সংক্রান্ত কার্যাদি এতদুদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত বিধিমালা অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে, সম্পাদিত হবে।

সচিবালয় গঠন ও নিয়ন্ত্রণ

৪ ধারায় বলা হয়েছে, (১) সংবিধানের ২২, ১০৯ এবং ১১৬ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় নামে একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় থাকবে। (২) সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রধান বিচারপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সচিব উক্ত সচিবালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হবেন।

(৩) এই অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় সরকারের মন্ত্রণালয় যেইরূপ প্রশাসনিক কার্যক্রম গ্রহণ করার অধিকারী সেরূপ প্রশাসনিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারবে।

(৪) সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের একজন সচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী থাকবেন। (৫) সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সচিব সরকারের সিনিয়র সচিবের সমমর্যাদা ও সুবিধাদি ভোগ করবেন। (৬) সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সচিবের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কাজ-কর্ম পরিচালনা করবেন। (৭) প্রধান বিচারপতি প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ করে আদেশ জারি করতে পারবেন।

কার্যাবলি

৫ ধারায় বলা হয়েছে, (১) অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেনো, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কার্যাবলি নিম্নরূপ হবে-

(ক) দেশের বিচার প্রশাসন পরিচালনায় সুপ্রিম কোর্টকে সহায়তা প্রদান করবার নিমিত্ত অধস্তন আদালত ও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সব প্রশাসনিক ও সাচিবিক দায়িত্ব পালন,

(খ) অধস্তন আদালতের প্রতিষ্ঠা বা বিলোপ, সংখ্যা, গঠন ও এখতিয়ার নির্ধারণ;

(গ) অধস্তন আদালত ও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের বিচারক, বা ক্ষেত্রমত, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের কর্মের শর্তাবলি নির্ধারণ ও নিয়োগ;

(ঘ) সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পদ সৃজন, বিলোপ, বিন্যাস, নিয়োগ, কর্মের শর্তাবলি নির্ধারণ, পদায়ন, বদলি, শৃঙ্খলা, ছুটি, প্রশাসন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়:

(ঙ) সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রি, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ও বিচার বিভাগীয় কর্মচারীদের পদ সৃজন, বিলোপ ও বিন্যাস;

(চ) সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়, সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রি ও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সাংগঠনিক কাঠামো নির্ধারণ ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে হালনাগাদকরণ;

(ছ) অধস্তন আদালত, সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রি এবং সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়-সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানসমূহের সাংগঠনিক কাঠামো নির্ধারণ ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে হালনাগাদকরণ:

(জ) অধস্তন আদালতের পদ সৃজন সংক্রান্ত বিষয়াদিতে সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত বিধিমালায় বর্ণিত কমিটিকে প্রয়োজনীয় সাচিবিক ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান;

(ঝ) বিচারিক কর্মে নিয়োজিত সার্ভিস সদস্যদের পদায়ন, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা ও ছুটি সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়:

(ঞ) সার্ভিস সদস্যগণের পদায়ন ও বদলি সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন;

আরও পড়ুন : সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের প্রথম সচিব হাবিবুর রহমান

(ট) অধস্তন আদালত, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল এবং সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানসমূহের বাজেট ব্যবস্থাপনা;

(ঠ) সুপ্রিম কোর্ট, অধস্তন আদালত, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল এবং সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নয়ন বা কারিগরি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন;

(ড) প্রধান বিচারপতির এবং সুপ্রিম কোর্ট, অধস্তন আদালত, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ও উক্ত আদালতসমূহের বিচারকগণের নিরাপত্তা তত্ত্বাবধান;

(ঢ) সার্ভিস সদস্যগণের এবং সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় ও বিচার বিভাগীয় কর্মচারীদের শিক্ষা, বৃত্তি, প্রশিক্ষণ ও এতদসংক্রান্ত অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ;

(ণ) বিচারিক সেবার মানোন্নয়ন ও বিচার বিভাগের সংস্কারে প্রয়োজনীয় গবেষণা পরিচালনা, প্রকাশনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ,

(ত) অন্যান্য দেশের স্বাংবিধানিক আদালত, বিচার বিভাগ, বিচার বিভাগ-সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং আইনের শাসন ও মানবাধিকার সম্পর্কিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে এবং আইনের শাসন ও মানবাধিকার-সম্পর্কিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমে সহায়ক চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ইত্যাদি সম্পাদন ও বাস্তবায়ন;

(থ) সার্ভিস সংক্রান্ত বিধিমালাসহ প্রাসঙ্গিক কোনো আইনের অধীন অর্পিত যে কোনো দায়িত্ব পালন;

(দ) এই অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক আরোপিত দায়িত্ব পালন।

(২) বিচার বিভাগের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে আইন ও বিচার বিভাগ সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়কে এই অধ্যাদেশের অধীন কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে।

৬ ধারায় বলা হয়েছে, (১) সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় সরকারের যে কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর বা অফিসের সহিত অথবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সহিত সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবে। (২) কোনো ব্যক্তি বা সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা দপ্তর সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সহিত কোনো বিষয়ে যোগাযোগের প্রয়োজনবোধ করলে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবে।

(৩) প্রধান বিচারপতি আদেশ দ্বারা সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কার্যাবলি বণ্টন, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার ব্যবস্থা করতে পারবেন।

আরও পড়ুন : সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় স্থাপন–কার্যক্রম চালুর জন্য গেজেটসহ যাবতীয় কাজ শেষ করার আহ্বান

পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কমিটি সংক্রান্ত ৮ ধারায় বলা হয়েছে , (১) অধস্তন আদালত, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল, সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রি এবং সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়, সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানসমূহ সংক্রান্ত উন্নয়ন বা কারিগরি প্রকল্প চূড়ান্ত নিরীক্ষা ও সুপারিশ করার লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত সদস্য সমন্বয়ে একটি পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কমিটি পঠিত হবে, (ক) প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত আপিল বিভাগের ১ (এক) জন বিচারক, যিনি এর সভাপতিও হবেন; (খ) প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের ২ (দুই) জন বিচারক; (গ) সচিব, আইন ও বিচার বিভাগ; (ঘ) সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়; (ঙ) সচিব, পরিকল্পনা বিভাগ; (চ) রেজিস্ট্রার জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট; এবং (ছ) সচিব, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়, যিনি সদস্য-সচিবও হবেন।

(২) উপ-ধারা (১)-এ উল্লিখিত কমিটি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে এর কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করবে। (৩) উপ-ধারা (১)-এ উল্লিখিত কমিটি কর্তৃক সুপারিশকৃত্ব প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৫০ (পঞ্চাশ) কোটি টাকার মধ্যে থাকলে প্রধান বিচারপতি অনুমোদন করবেন এবং এর ঊর্ধ্বে হলে তা অনুমোদনের জন্য সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে উপস্থাপনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রীর নিকট সরাসরি প্রেরণ করা হবে।

(৪) প্রকল্প গ্রহণ, প্রণয়ন ও যাচাই-বাছাই করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সচিবের নেতৃত্বে প্রকল্প যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হবে।

(৫) প্রকল্প যাচাই-বাছাই কমিটি প্রকল্প যাচাই-বাছাই করবার ক্ষেত্রে ‘সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন নির্দেশিকা, ২০২২’ অনুসরণ করবে।

(৬) প্রকল্প যাচাই-বাছাই কমিটি কর্তৃক যাচাই-বাছাইকৃত প্রকল্প চূড়ান্ত নিরীক্ষা ও সুপারিশের জন্য উপ-ধারা (১)-এ উল্লিখিত কমিটির নিকট প্রেরণ করবে।

(৭) অনুন্নয়ন বাজেটের আওতায় কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উপ-ধারা (১)-এ উল্লিখিত কমিটি কর্তৃক সুপারিশকৃত স্কিমের প্রাক্কলিত ব্যয় ৫০ (পঞ্চাশ) কোটি টাকার মধ্যে থাকলে প্রধান বিচারপতি অনুমোদন করবেন এবং এর ঊর্ধ্বে হলে এরূপ স্কিম অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে প্রেরণ করা হবে।

আরও পড়ুন : সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ জারি, নির্বাহী বিভাগ থেকে পুরোপুরি পৃথক হলো বিচার বিভাগ 

(৮) সরকার সময়ে সময়ে, সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শ করে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে উপ-ধারা (৩) ও (৭)-এ উল্লিখিত আর্থিক সীমা মুদ্রাস্ফীতির সহিত সমন্বয় করে বা অন্য কোনো উপযুক্ত কারণে বাড়াতে পারবে।

এছাড়াও বিচার প্রশাসন সংক্রান্ত কমিটি, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় কমিশন গঠন, বাজেট ব্যবস্থাপনা, অর্থ ব্যয়, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ পদ্ধতি, শর্তাবলি, বেতন ইত্যাদি সম্পর্কে অধ্যাদেশে উল্লেখ রয়েছে।

এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় অধ্যাদেশ জারি হলো। দীর্ঘ সংগ্রামের ফলাফল পাওয়া গেল। আলহামদুলিল্লাহ।’

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘শুভ কামনা। তবে সঠিক বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে এর কার্যকারিতা।’

বিচার বিভাগ পৃথককরণে প্রথম পদক্ষেপ

১৯৭২ সালের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ‘নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ’ সংক্রান্ত ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হতে বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করবেন৷’

মাসদার হোসেন মামলা

১৯৭২ সালের পর ২০ বছর অতিক্রান্ত হলে এ নিয়ে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এর মধ্যে ১৯৯৪ সালে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বেতন গ্রেড নিয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সেই ক্ষোভ থেকে তৎকালীন বিচারক মাসদার হোসেনসহ ৪৪১ বিচারকের পক্ষে হাইকোর্টে রিট করা হয়। এই রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট ১৯৯৭ জুডিসিয়াল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র সার্ভিস করার আদেশ দেন। রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করে। সেই আপিলের শুনানি শেষে ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ রায় দেন।

রায়ে কয়েক দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের থাকবে; বিচার বিভাগ জাতীয় সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকবে না এবং জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ সব বিচারক স্বাধীনভাবে কাজ করবেন; জুডিসিয়ারির (নিম্ন আদালত) বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের ওপর নির্বাহী বিভাগের কোনো হাত থাকবে না। এই বাজেট সুপ্রিম কোর্ট প্রণয়ন এবং বরাদ্দ করবে।

পৃথক ঘোষণা

আপিল বিভাগের ওই রায় ঘোষণার প্রায় ৮ বছর পর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর তৎকালীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সেই ঘোষণা কাগজে কলমে রয়ে যায়।

নতুন উদ্যোগ

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশের প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের কয়েকজন বিচারপতি পদত্যাগ করেন। এরপর ১০ আগস্ট দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। এরপর ২১ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশ্যে অভিভাষণ দেন।

সেই ভাষণে প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের স্বার্থে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক। বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারকরা বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন মর্মে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না; যতদিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘ দিন ধরে বিরাজমান দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা, অর্থাৎ, সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।

সুপ্রিম কোর্টের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে

এরপর একই বছরের ২৭ অক্টোবর পৃথক সচিবালয়ের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠান। সেখানে বলা হয়, আমাদের সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নিশ্চিতকরণকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের সংবিধানে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক রাখার কথা বলা হলেও সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এদেশে বিচার বিভাগের কার্যকর পৃথকীকরণ অসম্পূর্ণই থেকে গেছে।

তবে একথা অনস্বীকার্য যে, এমন একটি প্রেক্ষাপট সত্ত্বেও বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ৭৯/১৯৯৯ নম্বর সিভিল আপিল মামলার রায়ে (যা মাসদার হোসেন মামলা নামেই অধিক সমাদৃত) নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের পূর্ণ রূপরেখা তুলে ধরার মাধ্যমে আমাদের দেশে ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির বাস্তবায়নের পথকে সুগম করে দিয়েছে। ওই রায়ে ক্ষমতার পৃথকীকরণের যে রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে তার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হলো দেশের বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা।

সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব

সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় স্থাপন এবং বিচার বিভাগের প্রশাসনিক ও আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে ঘোষিত নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের মূলনীতিকে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে অর্থবহ ও কার্যকররূপে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কমিশনের প্রস্তাবগুলো হলো:

(ক) বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং সর্বোপরি নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে পৃথকীকরণের জন্য পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় স্থাপন করতে হবে।

(খ) সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় স্থাপনের নিমিত্তে একটি স্বতন্ত্র আইন বিা অধ্যাদেশ প্রণয়ন করতে হবে।

(গ) রুলস অব বিজনেস যথাযথভাবে সংশোধন করতে হবে।

(ঘ) এলোকেশন অব বিজনেস সংশোধনপূর্বক আইন ও বিচার বিভাগ এবং সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কার্যপরিধি পৃথকীকরণপূর্বক স্ব স্ব কার্যপরিধি সন্নিবেশিত করতে হবে।

(ঙ) বিচার বিভাগের দাপ্তরিক কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় নির্দেশমালা প্রণয়ন করতে হবে।

(চ) সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের জন্য পৃথক জনবল কাঠামো সম্বলিত সাংগঠনিক কাঠামো প্রস্তুত ও অনুমোদন করতে আসবে। অনুমোদিত সাংগঠনিক কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত জনবলের পদ সৃষ্টিসহ টিওএন্ডইতে অন্তর্ভুক্ত অফিস সরঞ্জামাদির প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।

(ছ) সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের জন্য পৃথক অবকাঠামো, জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট নিশ্চিত করতে হবে।

হাইকোর্ট বিভাগের রায়

সুপ্রিম কোর্টের সাত আইনজীবীর গত বছরের ২৫ আগস্ট করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে চলতি বছরের ২ সেপ্টেম্বর রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে বিদ্যমান ১১৬ অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জন্য সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষের প্রস্তাব অনুসারে রায়ের অনুলিপি গ্রহণের পর বিশেষত তিন মাসের মধ্যে সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে বিবাদীদের নির্দেশ দেওয়া হলো।