চট্টগ্রামের রেডিসন ব্লু হোটেলের কনফারেন্স হলে শনিবার সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও United Nations Development Programme (UNDP) আয়োজিত “Operationalizing Commercial Court” শীর্ষক সেমিনার। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, গত দেড় বছরে সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সাংবিধানিক স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বিচার ব্যবস্থায় যে মৌলিক রূপান্তর সাধিত হয়েছে, তা দেশের বিচারিক ইতিহাসে এক মাইলফলক।
এর মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ এক নতুন প্রাতিষ্ঠানিক যুগে প্রবেশ করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বরে তাঁর ঘোষিত বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ (Roadmap) বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা এবং বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা সুদৃঢ় করার একটি দৃঢ় অঙ্গীকার হিসেবে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে আসছে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, সুপ্রীম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫ প্রণয়নের মাধ্যমে বহুদিনের দ্বৈত প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা দূর হয়েছে এবং সুপ্রীম কোর্ট প্রথমবারের মতো পূর্ণ প্রশাসনিক ও আর্থিক স্বায়ত্তশাসন লাভ করেছে। এর ফলে বিচার বিভাগ এখন নিজস্বভাবে পদসৃজন, বাজেট বরাদ্দ, প্রশিক্ষণ উন্নয়ন, নীতিমালা প্রণয়নসহ বিচার সংস্কারকে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই ধারা হিসেবে এগিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে।
তিনি আরও জানান, সারাদেশব্যাপী বিভাগীয় সেমিনার ও জাতীয় প্লেনারি সেশন আয়োজনের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও দক্ষতা বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা UNDP, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক অংশীদারগণের কারিগরি সহায়তা এই প্রক্রিয়াকে সমৃদ্ধ করেছে।
আরও পড়ুন : প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে থাকবেন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম
প্রধান বিচারপতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশংসা করে বলেন, সুপ্রীম কোর্টের প্রস্তাবসমূহ সরকার দ্রুততার সঙ্গে অনুমোদন করেছে, যা শক্তিশালী ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা নির্মাণে জাতীয় ঐকমত্যকে প্রতিফলিত করে।
বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য নতুন দিগন্তের উন্মোচন করবে মর্মে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে দ্রুত ও আধুনিক বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি ডেডিকেটেড বা বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠার আহবান করে এসেছিলো যা শীঘ্রই বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে।
তিনি উল্লেখ করেন, সুপ্রীম কোর্টের একটি গবেষক দল বাণিজ্যিক আদালত সংক্রান্ত আইনের প্রাথমিক খসড়া তৈরি করে, যা পরবর্তীতে সারাদেশব্যাপী রোডশো, BIDA–র সঙ্গে নিবিড় পরামর্শ, ব্যবসায়িক আইন বিশেষজ্ঞ এবং বাণিজ্যিক অংশীজনদের মতামতের মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধ হয়। এক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নও গুরুত্বপূর্ণ কারিগরি সহায়তা প্রদান করে। পরবর্তীতে আইন মন্ত্রণালয়ের আরও পরীক্ষণ ও পরিমার্জনের পর খসড়াটি এখন চূড়ান্ত আইনগত রূপ পেয়েছে এবং গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভায় নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়েছে।
তিনি জানান, খসড়া আইনটিতে বাণিজ্যিক বিরোধের সুস্পষ্ট সংজ্ঞা, পর্যাপ্ত সংখ্যক বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠার বিধান, হাইকোর্ট বিভাগে পৃথক আপীল বেঞ্চ, বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা, সীমিত মুলতবি, সারসংক্ষেপ বিচার, মামলার পরিসংখ্যানের স্বচ্ছ প্রকাশ এবং বিচারক–আইনজীবীদের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের মতো আধুনিক বিধান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব বিধান দ্রুত, দক্ষ ও স্বচ্ছ বাণিজ্যিক বিচার নিশ্চিত করবে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা–ক্ষমতা বাড়াবে মর্মে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, কোনো আইন কেবল তখনই কার্যকর হয় যখন তা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়। এজন্য বাণিজ্যিক আদালতসমূহের সফল পরিচালনার জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন, মানবসম্পদ বিকাশ, ডিজিটাল সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সব পক্ষ–পেশাজীবীর সমন্বিত প্রচেষ্টা জরুরি।
আরও পড়ুন : পুলিশ কমিশনের প্রধান হবেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, অধ্যাদেশ অনুমোদন
তিনি জানান, সুপ্রীম কোর্ট বাণিজ্যিক বিরোধের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় প্র্যাকটিস ডাইরেকশন ও নির্দেশিকা জারি করতে প্রস্তুত।
এছাড়া, তিনি আইনজীবী সমাজ ও বিচার–সম্পর্কিত সকল অংশীজনকে সততা, শৃঙ্খলা ও দক্ষতার সঙ্গে বাণিজ্যিক আদালত আইন বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।
উক্ত অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন UNDP, Bangladesh এর Resident Representative মি. স্টেফান লিলার (Mr. Stefan Liller)। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন Embassy of Sweden in Dhaka এর Head of Politics, Trade and Communication মি. অলি লুন্ডিন (Mr. Olle Lundin), Deputy High Commissioner of Australia to Bangladesh মি. ক্লিন্টন পুকি (Mr. Clinton pobke), বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডার রাষ্ট্রদূত অজিত সিং (Ajit Singh), বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস (Nicholas Weeks)l এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার (Michael Miller)। আরো উপস্থিত ছিলেন সুপ্রীম কোর্ট সচিবালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ও সুপ্রীম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল, চট্টগ্রাম বারের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও বিজ্ঞ আইনজীবীবৃন্দ, চট্টগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ের বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তাবৃন্দ।
উল্লেখ্য, উক্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের নিমিত্ত চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তাবৃন্দের মনোনয়ন প্রদান করে বিগত ০২ ডিসেম্বর ২০২৫ খ্রি. তারিখ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার শাখা হতে এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামে কর্মরত বিচার বিচাগীয় কর্মকর্তাবৃন্দ, চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সদস্যবৃন্দ, অ্যাটর্নি-জেনারেল কার্যালয়ের ইন্টার্নগণ, চট্টগ্রাম চেম্বার অফ কমার্সের প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে গতকাল ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ খ্রি.তারিখ রোজ শুক্রবার বিকালে মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয় চট্টগ্রামের বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তাদের সাথে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে একটি মতবিনিময় সভা করেন।

