স্বপন হোসাইন : ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর উগ্রপন্থী হিন্দুরা ভারতের অযোধ্যায় অবস্থিত ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দিয়েছিল প্রকাশ্য দিবালোকে। এটা এমন এক ঘটনা যা ভারতবর্ষের মুসলিমদের হৃদয়ে তো ব্যথা দিয়েছিলই, একই সাথে তা ভারতের সাংবিধানিক মূলনীতি ‘সেক্যুলারিজম’-এর উপর বিরাট আঘাত হেনেছিল।
যে সময়ে উগ্রবাদীরা বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়, ঐ সময়ে বাবরি মসজিদ সহ আরো কিছু জায়গা সরকার অধিগ্রহণ করে নিয়েছিল এবং সেই বিষয়ে হাইকোর্টে মামলা চলমান ছিল। অধিগ্রহণ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত আসার আগ পর্যন্ত সকলপক্ষকে বাবরি মসজিদ সহ আশপাশের জমি বাবদে status quo বজায় রাখার কথা বলা হয়েছিল । আদালত অধিগ্রহণ অবৈধ ঘোষণা করে রায়ও দিল ১১ ডিসেম্বর। কিন্তু সেটা হলো অনেকটা “ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা যাওয়া” এর মতো। ততক্ষণে বাবরি মসজিদের অস্তিত্ব মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে।
১৯৯১ সালে সকল ধর্মীয় উপাসনালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারতীয় আইনসভা The Places of Worship (Special Provisions) Act, 1991 নামে একটা আইন করলো। এই আইনের প্রস্তাবনায় বলা হলো, An Act to prohibit conversion of any place of worship and to provide for the maintenance of the religious character of any place of worship as it existed on the 15th day of August, 1947, and for matters connected therewith or incidental thereto.
এই আইনের ৩ নং ধারায় ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টে ধর্মীয় উপাসনালয় হিসেবে বিদ্যমান থাকা কোনো উপাসনালয় কোনোরূপ পরিবর্তন নিষিদ্ধ করা হলো এবং এমন কার্যকে অপরাধ হিসেবেও ঘোষণা করা হলো।
কিন্তু, এই আইনের ৫ নং ধারাতে বিশেষভাবে বলা হলো যে, এই আইনের কোনো কিছুই রাম জন্মভূমি- বাবরি মসজিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
বিষয়টা আসলেই অবাক করার মতো। এই আইন কার্যকর হওয়ার একবছর পরেই বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দিল উগ্রপন্থী হিন্দুরা। যেন এই আইনের উদ্দেশ্যই ছিল বাবরি মসজিদ টার্গেট করা।
আরও পড়ুন :
ঐতিহাসিকভাবে বাবরি মসজিদ নির্মিত হয় সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকি কর্তৃক ১৫২৮/২৯ সালে। এরপরে মুঘলরা ক্ষমতায় থাকা কালীন এই মসজিদ নিয়ে কোনো ঝামেলা হয়নি। হিন্দুরাও সে জায়গা নিয়ে কোনো দাবি তোলেনি।
ঝামেলা শুরু হলো ১৮৫৬/৫৭ সালে, তথা যখন ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশের কর্তৃত্ব নিজ হাতে তুলে নিতে যাচ্ছিল তার প্রাক্কালে। সেই সময়ে বাবরি মসজিদের জায়গা নিয়ে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে একটি দাঙ্গা হয়। ব্রিটিশরা বিষয়টির একটি সুরাহা করতে বাবরি মসজিদের ভিতরের ও বাইরের অংশের মাঝখানে একটি দেয়াল টেনে দেয়। এর ফলে, মুসলিমরা পেল বাবরি মসজিদের ভিতরের অংশ এবং হিন্দুরা পেল বাবরি মসজিদের বাইরের অংশ। এরমধ্যে আরো ছোটোখাটো কিছু মামলা হয় আদালতে।
অতঃপর ১৮৮৫ সালে মহন্ত রঘুবীর দাস বাবরি মসজিদের পাশেই একটি মন্দির নির্মাণের অনুমতি চেয়ে মামলা করেন, কিন্তু এমন অনুমতি হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে দাঙ্গার সৃষ্টি করবে ভেবে সে অনুমতি দেওয়া হয়নি এবং মামলাটি খারিজ করা হয়।
১৯৩৪ সালে আবার দাঙ্গা হয় এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে দেয় হিন্দুরা। সে সময় ব্রিটিশ সরকারের অর্থায়নে বাবরি মসজিদ মেরামত করা হয়।
পরবর্তীতে দেশভাগের কিছু পরেই ১৯৪৯ সালে বাবরি মসজিদের ভিতরে কেউ একজন হিন্দুদের দেবতা রামের মূর্তি রাখে। হিন্দুরা প্রচার করতে থাকে যে, সেখানে স্বয়ং দেবতা রামের আবির্ভাব ঘটেছে এবং হিন্দুরা সেখানে পূজা করতে হকদার। সে সময় হিন্দুদের বাবরি মসজিদের বাইরের অংশে পূজার অনুমতি দেওয়া হলেও মুসলিমদের মসজিদে প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে সেশনস কোর্টের আদেশে বাবরি মসজিদের ভিতরের দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং হিন্দুদের পূজা ও দর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়। এ সময় মুসলিমরা Babri Mosque Action Committee গঠন করে।
আরও পড়ুন :
উল্লেখ্য, বাবরি মসজিদের মালিকানা ও দখলের দাবি নিয়ে ৫ টা সিভিল মামলা দায়ের করা হয় বিভিন্ন সময়ে, যার মধ্যে একটা মামলা উইথড্রো করা হলে বাকি চারটি মামলা একত্রে এলাহাবাদ হাইকোর্টে বিচারের জন্য পাঠানো হয়। ইতোমধ্যে বাবরি মসজিদ সহ আরো অন্যান্য জায়গা সরকার পুনরায় অধিগ্রহণ করে এবং সেটার সাংবিধানিকতা চ্যালেঞ্জ করা হলে সুপ্রিম কোর্ট তা সাংবিধানিক বলে ঘোষণা দেয়। এই মামলায় কোর্ট অদ্ভুত এক সিদ্ধান্তে বলে যে, মসজিদ কোনো অপরিহার্য উপাসনালয় না!
এলাহাবাদ হাইকোর্ট বাবরি মসজিদের মালিকানা নিয়ে মামলাসমূহের বিচার শেষে বাবরি মসজিদ ও এর আশপাশের জায়গা তিন ভাগে ভাগ করে দেয়। কিন্তু এলাহাবাদ হাইকোর্টের এই রায় বাতিল করে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯ সালে বাবরি মসজিদ নিয়ে এক ঐতিহাসিক কিন্তু চরম বিতর্কিত রায় প্রদান করে। উল্লেখ্য, এই মামলার বাদী হিসেবে দেখানো হয় স্বয়ং হিন্দু ধর্মের দেবতা রামকে।
সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদের রায়ে একেক একেক জায়গায় একেক রকম যুক্তি দেখিয়েছে। তবে স্বীকার করেছে যে, The Muslims have been wrongly deprived of a mosque which had been constructed well over 450 years ago.
রায়ের মধ্যে এক জায়গায় বলা হলো যে, মুসলিমরা বাবরি মসজিদের উপর তাদের exclusive possession প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
মুসলিমদের physical possession কে material হিসেবে আখ্যায়িত করা হলো, কিন্তু বাবরি মসজিদ সহ তর্কিত সম্পত্তিতে অধিকার প্রাপ্তির দিক গুরুত্ব দেওয়া হলো সেখানে উপাসনা কারা করে আসছে কিংবা কাদের ধর্মীয় অনুভূতি অধিক সেদিকটায়। এদিকটাও বিবেচনা করতে এক পাক্ষিক সাক্ষ্য-প্রমাণ গৃহীত হলো। ১৮৫৮ সালের আগে বাবরি মসজিদে মুসলিমদের যে দখল ছিল তা একেবারেই বিবেচনায় নেওয়া হলো না। কিন্তু ঠিকই পরবর্তীতে কোর্ট স্বীকার করলো যে, মসজিদ ওখানে ৪৫০ বছর ধরে আছে। আর কোনো মসজিদ এমনিতেই থাকে না, অবশ্যই সেখানে মুসলিমরা নামাজ আদায় করেছে।
আরও পড়ুন :
কিন্তু কোর্টের যুক্তি হলো, মুসলিমরা সেখানে নিয়মিত নামাজ আদায় করেছে তা প্রমাণিত হয়নি, কিন্তু হিন্দুরা যে পূজা করেছে তা প্রমাণিত হয়। Possession প্রমাণ করতে হিন্দুদের ক্ষেত্রে mental element কে গুরুত্ব দেওয়া হলেও, মুসলিমদের ক্ষেত্রে সেটার কোনো গুরুত্ব না দিয়ে factual elements এর উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় (সেটাও একপাক্ষিকভাবে)।
রায়ে এক জায়গায় বলা হয়, ভারতীয় সংবিধানের আলোকে ব্রিটিশ সরকারের কার্যাবলী গ্রহণ করা হয়েছে তথা existing acts to continue in force হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং এর পূর্বের কোনো কিছু স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এটাও যদি ধরা হয়, তাহলে ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশরা মুসলিমদের বাবরি মসজিদের উপর যে অধিকার দিয়েছিল সেটা তো অন্তত দেওয়ার কথা।
Archaeological Survey of India (ASI) এর রিপোর্টের উপর কোর্ট বিশেষ গুরুত্ব দেয়। সেই রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে কোর্ট বলে, Though there was a structure beneath the Babri mosque structure that was razed to the ground on 6 December 1992, though the ASI was not able to establish whether it was a temple or not but they were sure that the structure was non-Islamic.
তার মানে রাম-মন্দির ভেঙেই যে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে কিনা তার প্রমাণ নেই।
উল্লেখ্য, এই রায়-ই ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের প্রথম রায় যেখানে কোনো নির্দিষ্ট author judge নেই।
আরও পড়ুন :
বাবরি মসজিদ মামলার জন্য গঠিত বেঞ্চে ছিলেন মোট ৫ জন বিচারপতি; বিচারপতি রঞ্জন গগোই, বিচারপতি অশোক ভূষণ, বিচারপতি শরদ অরভিন্দ ববডে, বিচারপতি ডি.ওয়াই চন্দ্রচূড় ও একমাত্র মুসলিম বিচারপতি আব্দুল নাজির।
এখানে একটা বিষয় লক্ষ্য করে দেখা যায়, পরবর্তীতে বিচারপতি রঞ্জন গগোই প্রেসিডেন্ট মনোনীত একজন রাজ্যসভা সদস্য হন, বিচারপতি, ডি.ওয়াই চন্দ্রচূড় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হন, এবং বিচারপতি আব্দুল নাজির অন্ধ্র প্রদেশের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০২৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের বিতর্কিত রায়ের আলোকে বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম-মন্দির স্থাপন তথা রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠা-এর অনুষ্ঠানে উক্ত বিচারপতিদের দাওয়াত করা হয়েছিল। কিন্তু একজন বিচারপতি উপস্থিত থাকতে পেরেছিলেন।
যাইহোক, বাবরি মসজিদ রায়টা যে pre-determined বা পূর্ব-নির্ধারিত ছিল এটা যে কেউ বুঝতে পারে। এই রায়ের মাধ্যমেই ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট তাদের গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে হারিয়েছে। ভারতের সেক্যুলারিজমের উপর মারাত্মক আঘাত হানে এই রায়। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে উক্ত রায় সরেজমিনে কার্যকর করার মধ্য দিয়ে উল্লিখিত আঘাতের ষোলকলা পূর্ণ করা হয় এবং ভারতে ধর্মীয় উগ্রবাদের নতুন যুগ চালু করা হয়।
সবশেষে বাবরি মসজিদ মামলার রায় থেকে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একটা আইরনি উল্লেখ করে শেষ করছি, “Tolerance and mutual co-existence nourish the secular commitment of our nation and its people.”
লেখক : স্বপন হোসাইন; জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বগুড়া।

