বিচার বিভাগে আইন মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব বিলোপ করতে হবে: প্রধান বিচারপতি
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ

বিচার বিভাগে অনন্য নজির রেখে বিদায় নিচ্ছেন প্রধান বিচারপতি

ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। হাইকোর্ট বিভাগ থেকে সরাসরি হওয়া দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি। এক বছর তিন মাস দায়িত্ব পালন করে তিনি বিচার বিভাগে রেখে যাচ্ছেন অনন্য অনেক নজির। পৃথক সচিবালয় স্থাপন, বিচারপতি নিয়োগ কমিটি, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ও বহির্বিশ্বের বিচার বিভাগের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি তার দায়িত্বকালের বড় সফলতা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

আসছে ২৭শে ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতির শেষ কর্মদিবস। এদিনসহ আগের দুইদিন সরকারি ছুটি থাকায় তিনদিন আগেই ২৪শে ডিসেম্বর তাঁর বিচারিক জীবনের সমাপ্তি হচ্ছে। অর্থাৎ তিনি অবসরে যাচ্ছেন। এদিকে আজ বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এজলাস কক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে তাঁকে বিদায় সংবর্ধনায় দেওয়া হয়।

ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথগ্রহণের পর বিচার বিভাগ ও বিচারপ্রার্থীদের কল্যাণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণ করে সারা দেশের বিচারকদের উদ্দেশ্যে তিনি অভিভাষণ দেন। সেই অভিভাষণে তিনি বিচার বিভাগের জন্য রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। যার মধ্যে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করে স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, বিচারক নিয়োগে আলাদা আইন প্রণয়নসহ নানা পরিকল্পনার কথা বলেন।

প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের এক বছর তিন মাসের দায়িত্ব পালনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে সাবেক জেলা ও দায়রা জজ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহজাহান সাজু বলেন, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় বিশেষ করে বিচারপতি নিয়োগ নিয়োগ আইন, পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠাসহ নানা উদ্যোগের কারণে ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এ সব কাজ এতটা সহজ ছিল না।

আরও পড়ুনরাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধান বিচারপতির বিদায়ী সাক্ষাৎ

তিনি বলেন, কাজপাগল মানুষ হওয়ার কারণেই নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে স্বাধীন করতে পৃথক সচিবালয়ের ভিত গড়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, এর বাস্তবায়নও করে গেছেন। আগে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে অভিযোগের অন্ত: থাকতো না। নিয়োগের পরের দিনই বের হয়ে আসতো কীভাবে নিয়োগ হয়েছেন তার নানা কাহিনী। কিন্তু ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের আমলে দুই দফা ৪৮ জন বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে। কিন্তু নিয়োগ নিয়ে কোনো বিতর্কের কথা শুনিনি।

ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদকে একজন সফল প্রধান বিচারপতি উল্লেখ করে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সজল বলেন, বিচার বিভাগে স্বাধীনতার পর ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের মতো এতো দক্ষ, যোগ্য, মেধাবী প্রধান বিচারপতি এসেছেন কিনা আমার জানা নেই। তিনি এতো অল্প সময়ে বিচার বিভাগকে উচ্চতায় নিয়ে যেতে যা করেছেন তা আইনাঙ্গনে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

তিনি আরও বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম হাইকোর্ট বিভাগ থেকে সরাসরি তিনি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ পেয়েছেন।

জামায়াত সমর্থিত আইনজীবী সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের সভাপতি অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার বলেন, ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বিচার বিভাগে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আইনের মধ্যে থেকে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনায় সচেষ্ট ছিলেন।

নতুন নতুন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বিচার বিভাগের

ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সঙ্গে নতুন নতুন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। বিগত সময়ে ভারতের ভুপালে অবস্থিত ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি এবং স্টেট জুডিশিয়াল একাডেমিতে বাংলাদেশের অধঃস্তন আদালতের বিচারকরা প্রশিক্ষণ নিতেন। কিন্তু তিনি দায়িত্ব নিয়ে এর বাইরে নতুন করে মিশরের সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। চুক্তি হয়েছে ব্রাজিলের সঙ্গেও।

এছাড়া বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে বিচার বিভাগীয় সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিচারিক অভিজ্ঞতা বিনিময়, মানবাধিকার সুরক্ষা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সক্ষমতা বাড়ানো শীর্ষক নানা কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বিচার বিভাগীয় পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য থাইল্যান্ড, তুরস্ক, আরব-আমিরাত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল ও মিশর সফর করেছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন বলেন, প্রধান বিচারপতি বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে বহির্বিশ্বে তুলে ধরছেন। তার আমলে সুইডেন ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি চুক্তি ও মিশরের সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। ব্রাজিলের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার উন্নয়ন, পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থার দক্ষতা বাড়ানোর ওপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।

সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় স্থাপন

বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বতন্ত্রীকরণ নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হতে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় উদ্বোধন করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক ভবন (সুপ্রিম কোর্ট জামে মসজিদসংলগ্ন) দ্বিতীয় তলার দু’টি কক্ষে সচিবালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশের ৮ (১) ধারা অনুযায়ী অধস্তন আদালত, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল, সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রি ও সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত উন্নয়ন বা কারিগরি প্রকল্প চূড়ান্ত নিরীক্ষা ও সুপারিশ করার উদ্দশ্যে প্রধান বিচারপতি আট সদস্যবিশিষ্ট একটি ‘পরিকল্পনা ও উন্নয়ন’ কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রি, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ও অধস্তন আদালতের সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তনসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদ সৃষ্টি, বিলোপ বা বিন্যাসে ‘পদ সৃজন’ কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্গঠন

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর কারণে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ কর্তৃক ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষিত হলেও এ সংক্রান্ত রিভিউ দরখাস্তটি অনিষ্পন্ন ছিল। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

গত ১৪ই ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট অডিটোরিয়ামে বিদায়ী অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, পৃথক সচিবালয় এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে এদেশের আপামর জনসাধারণের সাংবিধানিক সকল অধিকার সুরক্ষিত করার প্রধান নিয়ন্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

অসৎ ও অসাধু বিচারকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিচারকদের দ্বারা সৃষ্ট যাবতীয় অন্যায়ের জন্য এখন থেকে অন্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ বন্ধ করতে হবে। জনগণের জন্য সংক্ষিপ্ত সময়ে সুবিচার নিশ্চিত করতে শতভাগ দায়িত্ব পালন করতে হবে। পছন্দসই পদায়নের জন্য রাজনৈতিক পদলেহন পরিহার করতে হবে।

আরও পড়ুনসংবিধান পরিবর্তনকে হুমকি নয়, গণতান্ত্রিক সত্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে

তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, আইন বৃহত্তর রাজনীতির একটা অঙ্গ হলেও, বিচারকদেরকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠার প্রয়াস রপ্ত করতে হয়। কেবল ক্ষমতাবান শাসক শ্রেণির পক্ষে প্রয়োজনীয় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব নিলে বিচার বিভাগের আলাদা কোনো অস্তিত্বেরই প্রয়োজন নেই। সে কাজের জন্য নির্বাহী বিভাগ ও পুলিশই যথেষ্ট। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ভিত্তি যে আদর্শকে ধারণ করেই গড়ে উঠুক না কেন, বিচারকদেরকে সুনীতি ও সুবিবেচনা বজায় রেখে কাজ করতে হবে।

উল্লেখ্য, গত বছরের ১০ই আগস্ট নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং ১১ই আগস্ট শপথ গ্রহণ করেন ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তিনি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্টের প্রয়াত জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ও প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদের ছেলে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

পরে যুক্তরাজ্য থেকে বিএ ও এমএ এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৪ সালে জেলা আদালতে, ১৯৮৬ সালে হাইকোর্টে এবং ২০০২ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০০৩ সালের ২৭শে এপ্রিল অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে হাইকোর্টে নিয়োগ পান এবং ২০০৫ সালের ২৭শে এপ্রিল হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হন।