রাজীব কুমার দেব:
“আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে” – ফৌজদারি বিচার নিষ্পত্তিতে একটি মৌলিক সাংবিধানিক নীতিঃ এই নীতির অনুসরণ যেমন best categorised criminal justice প্রতিষ্ঠা করতে সম্ভব তেমনি এই নীতির ব্যপ্তয় সাংবিধানিক মৌলিক কাঠামোকে আঘাত করে অকল্যাণকর রাষ্ট্রের বাস্তবতা কে উৎসাহিত করতে পারে।
আমাদের বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতিগত আইনগুলো ব্রিটিশ আমলের প্রত্যক্ষ শাসনব্যবস্থার ফসল। তখনকার সমাজব্যবস্থা, সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি নীতি, বর্ণবাদ, আন্তঃগোত্রীয় বিদ্বেষ এবং সর্বোপরি উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কায়েমের স্বার্থ বিবেচনায় মূল আইন সহ পদ্ধতিগত আইন তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সমাজ ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন এবং তথ্য প্রযুক্তির ছোয়ায় অপরাধের ধরণ পরিবর্তিত হলেও তদবিবেচনায় পদ্ধতিগত আইনের পরিবর্তন হয়নি। তাই পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় বৈশ্বয়িক অগ্রগতিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কায়েমী স্বার্থে প্রস্তুতকৃত আইন যথাসময় বিচার নিষ্পত্তিতে বাধার সৃষ্টি করছিল। সর্ব্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে ফৌজদারি পদ্ধতিগত বিচার ব্যবস্থার সাথে “সংক্ষিপ্ত বিচার পদ্ধতি” ধারণার সন্নিবেশ করা হয়।
আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় আইনের আশ্রয় লাভ এবং বিচার ও দন্ড সংক্রান্ত মৌলিক সাংবিধানিক বিধানের অন্যতম শর্ত হচ্ছে কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ প্রত্যেকের অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং আইনানুযায়ী ব্যতীত। আইনের Due process of law নীতি অনুসরণ করে এখতিয়াসম্পন্ন আদালত কর্তৃক আইনে নির্ধারিত অপরাধের বিচার ও দন্ড প্রদান করা আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভের অন্যতম শর্ত। অর্থাৎ Due process of law নীতি অনুসরণ না করে বিচার ও দন্ড প্রদান কিংবা এখতিয়ারবিহীন আদালত কর্তৃক দন্ড প্রদান কিংবা আইন কর্তৃক নির্ধারিত হয় নাই এমন অপরাধের বিচার ও দন্ড প্রদান কিংবা নিজেই অপরাধ বিচারের দায়িত্ব গ্রহণ আইনের ব্যত্যয় হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তদক্ষেত্রে বিচার ও দন্ড ভিসিয়েট হবে। দ্রুত সময়ে একটি বিচার নিষ্পত্তি করতে গিয়ে আইনের ব্যত্যয় ঘটালে তা আইনি ব্যবস্থার প্রতি সাধারণের বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হবে এবং সূচিত “সংক্ষিপ্ত বিচার পদ্ধতি” ধারণার মূল উদ্দেশ্যকে infructuous করে দিবে।
অস্বীকার করার উপায় নাই যে একটি বিচার নিষ্পত্তিতে কার্যবিধি যে সকল পর্যায় বিধৃত করেছে সে সকল পর্যায় প্রতিপালন করে পূর্ণাঙ্গ বিচারিক সিদ্ধান্ত দিতে যে সময় লাগে তা হয়তো delay of justice এর কারণ হতে পারে। বিদ্যমান বাস্তবতায় স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আইনের ছোট ছোট অপরাধসমূহ দ্রুত সময়ে বিচার নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ফৌজদারি কার্যবিধির বাইশ অধ্যায়ে “সংক্ষিপ্ত বিচার পদ্ধতি” এর প্রবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু পদ্ধতিগত আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে এবং অপরাধ সংগঠনের প্রবণতা বিবেচনায় “সংক্ষিপ্ত বিচার পদ্ধতি” ধারণাকে নির্ধারিত স্থান হতে এলাকাধীন বিবেচনায় “মোবাইল কোর্ট” ধারণায় সম্প্রসারিত করা হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রমকে কার্যকর ও অধিকতর দক্ষতার সাথে সম্পাদন করার জন্য মোবাইল কোর্ট পরিচালনার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় বিধান করবার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে মোবাইল কোর্ট আইন প্রবর্তন করা হয়। এই আইনে ১৭ টি ধারা ও একটি তফসিল আছে। সাথে সেভিং ক্লজও দেয়া হয়েছে। স্ব স্ব আঞ্চলিক অধিক্ষেত্রে এই আইনের অধীন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে এই আইনে নির্ধারিত ৯৯ টি অপরাধের আমলে গ্রহণ করে বিচার কার্য পরিচালনা করতঃ দণ্ড আরোপের ক্ষমতা থাকবে।
তবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে গিয়ে এই আইনে বর্ণিত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হলে “Mandatory provision of law” প্রতিপালন করতেই হবে। যেমন –
(ক) সংগঠিত অপরাধটি উক্ত আইনের তফসিলভূক্ত অপরাধ হতে হবে ( ৯৯ টি অপরাধের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে)।
(খ) অপরাধটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে সংগঠিত হতে হবে। অর্থাৎ অপরাধ সংগঠনের সময় মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেটকে ঘটনাস্থলে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে।
(গ) ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনাস্থলেই উক্ত অপরাধ আমলে গ্রহণ করবেন এবং ঘটনাস্থলেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে, স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে, দোষী সাব্যস্ত করে নির্ধারিত দণ্ড আরোপ করতে পারবেন।
এই তিনটি শর্ত হচ্ছে মোবাইল কোর্ট আইনের “Mandatory provision of law” যা অবশ্যই পালন করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেট আমল গ্রহণ, বিচার ও দন্ড প্রদান করতে পারবেন। এই তিনটি শর্তের কোন ব্যত্যয় ঘটলে তা আইনি ব্যত্যয় হিসেবে বিবেচিত হবে।
উল্লেখ্য, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৩০(কে ও কিউ) ধারার বিধান মতে যদি কোন এখতিয়ারবিহীন ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধ আমলে গ্রহণ করে সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে বিচার করেন তাহলে তার প্রসিডিংস বাতিল হবে।
আইনের বিদ্যমান বাস্তবতায় সারাদেশের মোবাইল কোর্ট কার্যক্রম সম্পর্কে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় যে সকল সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তা উদ্বেগজনক। অসংখ্য ঘটনায় অসংখ্য ব্যক্তিকে জনতা বা পুলিশ ধৃত করে পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থাপন করলে তিনি মোবাইল কোর্ট আইনে সাজা প্রদান করেন মর্মে সংবাদে প্রকাশ।
প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায়, রাজশাহীর গোদাগারীতে আগের দিন রাতে পুলিশ তিন নারীকে ধৃত করে পরের দিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করালে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার অফিসে বসেই তিন নারীকে প্রত্যেককে এক মাস করে কারাদণ্ড প্রদান করেন, জামালপুরের সরিষাবাড়ির ঘটনাস্থল হতে এক ব্যক্তি পালিয়ে গেলে পরে পুলিশ উক্ত ব্যক্তিকে ধৃত করে মোবাইল কোর্টে হাজির করালে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার অফিসে বসেই উক্ত ব্যক্তিকে তিন মাস কারাদণ্ড প্রদান করেন, রংপুরে পুলিশ ৯ ব্যক্তিকে ধৃত করে সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাজির করালে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার অফিসে বসেই ধৃত দের প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা করে জড়িমানা আরোপ করেন, কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশ ঘটনাস্থল হতে যথাক্রমে দশ, সাত ও তিন ব্যক্তিকে ধৃত করে মোবাইল কোর্টে হাজির করালে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার অফিসে বসেই উক্ত তিনব্যক্তিকে ছয় মাস কারাদণ্ড প্রদান করেন, যশোরের কেশবপুরে ইসলামপুরে শ্লীলতাহানির অভিযোগে গ্রাম্য সালিশি বৈঠক হতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশ ধৃত করে ইউএনও অফিসে নিয়ে গেলে তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ধৃত ব্যক্তিকে এক বছরের সাজা প্রদান করেন।
আবার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে আরো জানা যায়, মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী কর্তৃক এমনও কিছু শাস্তি প্রদান করা হয় যা মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিলভূক্ত অপরাধ নয়। এ প্রসঙ্গে চাঁদপুরের একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। আবার যেখানে ম্যাজিস্ট্রেট নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত তিনি নিজেই যদি মোবাইল কোর্ট আইনের ক্ষমতা প্রয়োগ করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তাহলে তা হবে জুরিস্প্রুডেন্সিয়াল ও সাংবিধানিক নীতি “No one shall be witness of his own case” ব্যত্যয়। এ প্রসঙ্গে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায়, নেত্রকোণা জেলার একজন ইউএনও বিআরটিসির বাসে করে নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার সময় তিনি নিজেই কটূক্তির শিকার হলে পরে পুলিশ অভিযুক্তকে ধৃত করে তার সামনে উপস্থাপন করলে তিনি নিজেই মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ধৃত ব্যক্তিকে এক মাসের কারাদণ্ড প্রদান করেন।
অনেকে যুক্তি দেখাতে পারেন যেহেতু অপরাধীকে অপরাধ সংগঠনের সময় জনতা বা পুলিশ কর্তৃক হাতে নাতে ধৃত করা হয়েছে সেহেতু এই ধরণের আইনি ব্যত্যয় ঘটিয়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করলে এমন আর ক্ষতি কি!! অপরাধ তো আর সবসময় ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে ঘটবে না!! – না, এটি হবে একটি গণতন্ত্র ও আইনের শাসনে বেষ্টিত দেশের জন্য ভয়ংকর ভাবনার প্রতিফলন যা সংবিধানের মূলনীতিকে আঘাত করবে।
এখন যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন – তাহলে আইনি ব্যত্যয়গুলো কিভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব? উল্লেখ্য, আইন বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা, Justice, Equity and Good Conscience নীতি, সাংবিধানিক বিধি বিধান, ফৌজদারি কার্যবিধির মূল নীতি এবং সর্বোপরি মহামান্য উচ্চাদালতের সিদ্ধান্ত মতে আইন বাস্তবায়নকারী সংস্থার আইনের ব্যত্যয়ের বিরুদ্ধে মহানান্য হাই কোর্ট স্যু ম্যুটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। অথবা স্থানীয় বিচারিক অঙ্গন Supervisory এখতিয়ার প্রয়োগ করে আইন বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে আইনের ব্যত্যয়ের বিষয়ে প্রশাসনিক ও বিচারিক প্রশ্নের সম্মুখীন করার উদ্দেশ্যে মাননীয় “Justice of Peace” অথবা আমলী ম্যাজিস্ট্রেট স্যু মোটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে সংশ্লিষ্ট হতে আইনি ব্যত্যয়ের বিষয়ে কৈফয়ত তলব করে প্রতিবেদনসহ মহামান্য হাইকোর্টের নজরে আনার লক্ষ্যে মাননীয় রেজিস্ট্রার বরাবরে প্রতিবেদন পাঠানোর মত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। আবার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসারে একটি Fabourable Judicial Environment প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আইনি ব্যত্যয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কেননা বর্তমানে বিচার বিভাগের একটি আধুনিক সংযোজন ও কার্যকরী পদক্ষেপ হচ্ছে পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেসি কনফারেন্স। এই কনফারেন্সে মোবাইল কোর্টের চলমান আইনি ব্যপ্তয় গুলো তুলে ধরে সংশ্লিষ্টদের অবগত করে সতর্ক হওয়ার বিষয়ে বার্তা দিলে আইনি ব্যত্যয় অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
একটি সত্য অস্বীকার করার উপায় নাই যে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাগণ আইনি ব্যত্যয়ের বিষয়ে অবগত থাকার কথা নয় তবে আইনি দায়িত্ব পালনকারী মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট আইনের প্রয়োগ বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল আছেন এটি ধরে নেওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই মোবাইল কোর্ট আইনের মৌলিক নীতি প্রয়োগে জুরিসপ্রুডেনশিয়াল, সাংবিধানিক ও আইনি ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলে (মোবাইল কোর্ট সংক্রান্ত মহামান্য আপীল বিভাগে বিচারাধীন আপীল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত) ইতিবাচক চিন্তাধারা প্রয়োগ করে স্থানীয় বিচারিক অঙ্গনের সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হতে আইনি পরামর্শ গ্রহণ করে এগিয়ে গেলে মোবাইল কোর্টের আইনি ব্যত্যয় অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
লেখক : জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, কক্সবাজার।