যেসব মামলায় নিম্ন আদালতে আসামিদের জামিন হয় না, ওইসব মামলার কাগজপত্র জালিয়াতি করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের মাধ্যমে উচ্চ আদালত থেকে জামিনের ব্যবস্থা করা হয়। আর এ জন্য আসামিপক্ষের লোকজনের কাছে পাঁচ লাখ থেকে শুরু করে আরও বেশি টাকা নেওয়া হয়।
সম্প্রতি জামিন জালিয়াত চক্রের মূলহোতাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। এর আগে একই ঘটনায় আরও এক আইনজীবীকে গ্রেফতার করা হয়। আর এদের গ্রেফতারের মধ্য দিয়েই জামিন জালিয়াতির চাঞ্চল্যকর এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
সিআইডির (অর্গানইসড ক্রাইম) বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সিআইডির মালিবাগ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান।
জালিয়াত চক্রের যারা গ্রেফতার হয়েছেন তারা হলেন- মূলহোতা দেলোয়ার হোসেন, সহযোগী এবিএম রায়হান ও শামীম রেজা। এর আগে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুসরোজ ঝর্ণা সাথির সহকারী হারুন অর রশীদকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘২০১৪ সালের রাজবাড়ী থানার একটি অস্ত্র মামলায় পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ইয়ার আলী ওরফে খোরশেদ বিল্লাল কারাগারে যায়। ২০১৬ সাল পর্যন্ত দুই বছর নিম্ন আদালতে জামিন না মেলায় উচ্চ আদালতে জামিন আবেদন করেন তিনি। পরে আইনজীবী ঝর্ণা সাথির মাধ্যমে ইয়ার আলী ছয় মাসের জামিন হয়। বিষয়টি তৎকালীন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরহাদ আহাম্মেদের সন্দেহ হলে রাজবাড়ী থানা থেকে কাগজপত্র তুলে জানতে পারেন, কাগজ জালিয়াতি করে ইয়ার আলীর জামিন করানো হয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জামিন জালিয়াতির বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনলে বিচারক পুরো ঘটনার বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে বলেন। এ ঘটনায় ওই সময় আইনজীবী ঝর্ণা সাথি ও শাহিনুর রহমানের নামে শাহবাগ থানায় একটি মামলা করে পুলিশ। শাহবাগ থানা পুলিশ তদন্ত করে ঝর্ণা সাথির নামে চার্জশিট দেয়। তবে উচ্চ আদালত চার্জশিট বাতিল করে অধিক তদন্তের জন্য সিআইডিকে দায়িত্ব দেয়।
বিশেষ পুলিশ সুপার জানান, সিআইডি দীর্ঘ তদন্ত শেষে ঝর্ণা সাথির সহকারী হারুণ অর রশীদকে গত ৯ জানুয়ারি গ্রেফতার করে। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর হারুন গত ১৩ জানুয়ারি স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দেয়। তার তথ্য মতে প্রযুক্তি ব্যবহার করে রংপুরের পীরগাছা ও কুড়িগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে মূলহোতাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে উচ্চ আদালতের বিচারপতি ও নিম্ন আদালতের বিচারকদের সিল, প্যাড ও জালিয়াতি করা বিপুল সংখ্যক কাগজপত্র জব্দ করা হয়।
সিআইডির পুলিশ সুপার বলেন, ‘জামিন জালিয়াত চক্রের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থান করে। এদের একটি গ্রুপ হাইকোর্টে রয়েছে। তবে মূলহোতারা রংপুরে ছিল। রাজবাড়ীর ওই মামলার কাগজপত্রগুলো প্রথমে রংপুরে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে জাল কাগজপত্র তৈরি করে হাইকোর্টে পাঠায়। এরপর হাইকোর্ট থেকে আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন আবেদন করেন এবং জামিন পান।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জামিন সঠিক ছিল। তবে জামিন নেওয়ার জন্য কাগজপত্র ছিল ভুয়া ও নকল। যেমন রাজবাড়ীর ওই অস্ত্র মামলায় আসামি ছিল একজন (ইয়ার আলী)। জালিয়াতি করে যখন কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে তখন ওই মামলায় আসামি হয়েছে দুজন। এরপর জাল কাগজপত্রে ইয়ার আলীর হাতে অস্ত্র পাওয়া যায়নি বলে দেখানো হয়েছে। বিচারক এটা দেখে ইয়ার আলীকে ছয় মাসের জামিন দেন।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে বিশেষ পুলিশ সুপার কামরুজ্জামান বলেন, ‘এর আগে এই চক্রটি ৫০ আসামিকে জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাইয়ে দিয়েছেন বলে মূলহোতা দেলোয়ার স্বীকার করেছেন।’
জামিন জালিয়াত চক্রের সদস্যরা এর আগে হাইকোর্ট বিভাগে বিভিন্ন আইনজীবীর সহকারী ছিলেন। এখন তারা জালিয়াতি করেন। কোনো আইনজীবীর হয়ে আর তারা কাজ করেন না।
এর পেছনে সুপ্রিম কোর্টের আর কারা জড়িত জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, ‘মূলহোতা দেলোয়ার পুরো চক্রের সাথে কারা কারা জড়িত সবার নাম বলেছেন। তবে তদন্তের স্বার্থে আমরা প্রকাশ করছি না। এই চক্রের সব সদস্যকে ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ইয়ার আলীর জামিনের জন্য চক্রটির সঙ্গে ৫ লাখ টাকার চুক্তি হয়েছিল। তবে ইয়ার আলী জামিনে বের হতে পারেনি। সিআইডি যখন এই মামলার অধিকতর তদন্ত করছিল, তখন আরও একজন সন্ত্রাসী জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছিল। টের পেয়ে বিষয়টি উচ্চ আদালতকে অবহিত করলে ওই সন্ত্রাসীও বের হতে পারেনি।