বিভিন্ন অপরাধে দণ্ডিত হয়ে দেশের কারাগারগুলোতে বন্দি আছেন পৌনে এক লাখের বেশি আসামি। এদের অনেকেই নানান ধরনের রোগে আক্রান্ত। কেন্দ্রীয় কারাগারগুলোতে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে বটে, তবে বেশি অসুস্থ হলে তাদের নেওয়া হয় কারাগারের বাইরে সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে। আবার অনেকেই রোগাক্রান্ত হওয়ার নাম করে নানা উপায়ে অসুস্থতার সনদ নিয়ে হাসপাতালগুলোতে অবস্থান করেন, এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তবে এ সুবিধা কেবল প্রভাবশালী ও বিত্তশালীদের কপালেই জোটে। সাধারণ বন্দিরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তখন কারা চিকিৎসকদের পরামর্শে তাদের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি করিয়ে থাকে কারা কর্তৃপক্ষ।
বর্তমানে ঢাকাসহ সারাদেশে শতাধিক বন্দি কারাগারের বাইরের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে কারা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে। যদিও কারা কর্তৃপক্ষের দাবি, কোনও অবৈধ সুবিধা নিয়ে নয়, প্রকৃত অসুস্থদেরই তারা কারাগারের বাইরের হাসপাতালগুলোতে পাঠিয়ে থাকেন।
কারা সূত্র জানায়, দেশের ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগারে বন্দি রয়েছেন ৮৭ হাজার ২৬৬ জন। এই হিসাব এ বছরের ২৩ জানুয়ারির। এসব কারাগারে বন্দি ধারণক্ষমতা রয়েছে ৪০ হাজার ৯৪৪ জনের। ফলে সংখ্যাটা ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ। সূত্র জানায়, ওয়ান ইলেভেনের সময় (২০০৭) কারাগারে বন্দির সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গিয়ে ৮০ হাজার ছাড়িয়েছিল। তখন কারাগারের ধারণক্ষমতা ছিল ২৭ হাজারের কিছু বেশি। মাঝে ৭০ থেকে ৮০ হাজারের মধ্যে বন্দির সংখ্যা থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে সেটা ৮৯ হাজার ছুঁয়েছিল।
কেন্দ্রীয় কারাগারগুলোতে কারা হাসপাতালের ব্যবস্থা আছে, তবে বেশিরভাগ জেলা কারাগারেই এখনও হাসপাতাল চালু হয়নি। কারা কর্তৃপক্ষ অনেক কারাগারে একটি ওয়ার্ডকে অসুস্থদের জন্য নির্ধারিত রেখেছে। যেগুলোকে কারা হাসপাতাল বলা হয়। দেশের কারাগারগুলোতে চিকিৎসকের পদ রয়েছে ১৪১টি। তবে এসব পদে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ২৩ জন চিকিৎসক। তাই কারাগারে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বন্দিকে স্থানীয় সরকারি হাসপাতালগুলোতে পাঠিয়ে দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। গত ২৩ জানুয়ারির (২০২০) হিসাব অনুযায়ী কারাগারের বাইরের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন আছেন ১০৬ জন।
কারা অধিদফতর সূত্র জানায়, বর্তমানে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বেশ ক’জন আলোচিত বন্দি। এসব বন্দির মধ্যে দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, অর্থ পাচার মামলার আসামি ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমিন, মাদক ব্যবসার গডফাদার হিসেবে পরিচিত ও ইয়াবা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি আমিন হুদা, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা ও পাসপোর্ট অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ওয়াহিদুল হক, সোনা চোরাচালান মামলার আসামি বাংলাদেশ তাইওয়ান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান খাজা শাহাদত উল্লাহ এবং ক্যাসিনো ব্যবসার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট রয়েছেন। তবে এদের অনেকের শারীরিক অবস্থা গুরুতর বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট বেশ কিছুদিন আইসিইউতে থাকলেও বর্তমানে কেবিনে রয়েছেন বলে সূত্র জানায়।
বিএসএমএমইউর প্রিজন সেলে এদের কেউ এসেছেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে, আবার কেউ এসেছেন কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে। তবে বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন প্রত্যেক বন্দিই থাকেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের তত্ত্বাবধানে।
এছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া আসামি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আরেক মানবতাবিরোধী মামলার আসামি মাওলানা আবদুস সোবহান, জঙ্গি নেতা আবু সালেহ জাকারিয়া চিকিৎসাধীন আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এছাড়া বিভিন্ন মামলার আসামি আবদুল করিম, কাজি মনির, আবদুস সালাম, পরিমল দাস, সেলিম মিয়া, দুলাল চন্দ্র সাহা, কল্পনা আক্তার, রুবিনা বেগম, রাজিয়া খাতুন ও শিরিন আক্তারও চিকিৎসা নিচ্ছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এদের কেউ কয়েদি কেউবা হাজতি হিসেবে কারাভোগ করছেন।
আলোচিত বন্দিদের দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহাবুবুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, কোনও বন্দি অসুস্থ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাদের বাইরের হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর প্রতি ১৫ দিন পর সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লেখা হয়, কেউ সুস্থ হয়ে থাকলে কিংবা কারাগারে পাঠানোর মতো অবস্থা হয়ে থাকলে তাদের যেন কারাগারে ফেরত পাঠানোর জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যতদিন ছাড়পত্র দিয়ে কারাগারে পাঠানোর কথা না বলবেন, ততদিন কারা কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে করার কিছু থাকে না। সূত্র- বাংলা ট্রিবিউন