মো. আব্বাস উদ্দিন রনি: ‘বিবাহ’ এর আরবী শব্দ হলো ‘নিকাহ’। নিকাহ এর শাব্দিক অর্থ হলো একত্রিত হওয়া, নারী পুরুষ মিলিত হওয়া। ইসলামী শরীয়াহ আইন অনুযায়ী, বিবাহ হল একজন নারী ও একজন পুরুষের মধ্যে পরস্পর সম্মতির ভিত্তিতে নিষ্পন্ন বৈধ বন্ধন ও সামাজিক চুক্তি। বিবাহের উদ্দেশ্য হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক ও ভালোবাসার বন্ধন তৈরি করা এবং একটি সুস্থ সমাজ গঠনে অবদান রাখা। একটি অবাঞ্ছিত বা সম্মতি ব্যতীত জোরপূর্বক বিবাহে উদ্দেশ্য পূরণ করা বা এর বৈধতার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। যা একটি সমাজ ও পরিবারের তথা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর নয়।
জাতীয় ও মুসলিম আইনে বিবাহ এবং সম্মতি
ইসলামে বিবাহ একটি সম্মতিমূলক ব্যবস্থা, উভয়পক্ষের সম্মতি দেওয়ার ক্ষমতা এবং স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন। ইসলামে জোরপূর্বক বিয়ের কোনো বৈধতা নেই। কাউকে জোর করে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া যাবে না, এবং শরীয়তে এ ধরনের বিবাহের কোন ভিত্তি নেই।
‘হেঈমাণদারগণ! বলপূর্বক নারীদেরকে উত্তরাধিকারে গ্রহণ করা তোমাদের জন্যে হালাল নয় এবং তাদেরকে আটক রেখোনা যাতে তোমরা তাদেরকে যা প্রদান করেছ তার কিয়দংশ নিয়ে নাও; কিন্তু তারা যদি কোন প্রকাশ্য অশ্লীলতা করে! নারীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপনকর। অতঃপর যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে হয়ত তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ, অনেক কল্যাণ রেখেছেন।’ [সূরা নিসা আয়াত নং১৯]
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, কোন বিধবা নারীকে তার সম্মতি ব্যতীত বিয়ে দেয়া যাবে না এবং কুমারী মহিলাকে তাঁর অনুমতি ছাড়া বিয়ে দিতে পারবে না। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রসূল! কেমন করে তার অনুমতি নেয়া হবে। তিনি বললেন, তার চুপ থাকাটাই তার অনুমতি। [৬৯৭০; মুসলিম১৬/৮, হাঃ ১৪১৯, আহমাদ ৯৬১১]
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ এবং মুসলিম শরিয়া আইন দ্বারা মুসলিম বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়াদি নির্ধারণ করা হয়। সাংবিধানিক আইনে বলা আছে, রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন। [অনুচ্ছেদ-২৮ (২)], আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে [অনুচ্ছেদ-৩১ ও ৩২]।
মুসলিম আইন অনুযায়ী, বিবাহ (নিকাহ) একটি চুক্তি [ Khodeja Begum v. Sadeq Sarkar 50 DLR (1998) (HCD) 181 at 184 para 20] এবং বিবাহের আইনগত শর্তহলো-
• প্রস্তাব প্রদান ও প্রস্তাব গ্রহণ (সম্মতি) [Dr. A.L.M. Abdulla v. Rokeya Khatoon and another 21 DLR (1969) (HCD) 213],
• সাক্ষীদের উপস্থিতি [ Momtaz Begum v Anowar Hossain 2011(40) CLC AD] এবং
• নির্ধারিত দেনমোহর। [Section 10, MFLO, 1961. See Atiqul Haque Chowdhury v Shahana Rahim 47 DLR(1995) (HCD) 301]
সম্মতির ভিত্তিতে শর্তসমূহ মেনে সম্পাদিত বিবাহ বৈধ বিবাহ হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু প্রকাশ্যে অসম্মতি সত্ত্বেও অভিভাবক কতৃক জোরপূর্বক বিবাহ ইসলামি আইনে অবৈধ ও বাতিল বলে গণ্য হবে।
আন্তর্জাতিক আইনে বিবাহ এবং সম্মতি
১৯৬৬ সালের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি এর অনুচ্ছেদ- ২৩ (৩) এবং সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা (১৯৪৮) এর অনুচ্ছেদ ১৬তে বলা হয়েছে, “স্বামী/স্ত্রীর স্বাধীন ও পূর্ণ সম্মতি ব্যতীত কোন বিবাহ করা যাবে না”। তাছাড়া, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর করা বিষয়ক কনভেনশন (১৯৭৯) এর ১৬ (বি) অনুসারে,“স্বাধীন ও পূর্ণসম্মতিতে একজন নারী ও পুরুষ স্বাধীনভাবে তাদের জীবনসঙ্গী নির্বাচন করার এবং বিবাহ করার সমান অধিকার থাকবে।“
বিবাহের সম্মতি, বিবাহের ন্যূনতম বয়স এবং বিবাহ নিবন্ধনসংক্রান্ত কনভেনশন ১৯৬৪ এর অনুচ্ছেদ ১(১) মতে,“উভয়পক্ষের সম্পূর্ণ এবং স্বাধীন সম্মতি ব্যতীত কোন বিবাহ আইনত সম্পাদন করানো যাবে না। এই ধরনের সম্মতি আইনদ্বারা নির্ধারিত ও বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের এবং সাক্ষীদের উপস্থিতিতে বিবাহে ইচ্ছুক পক্ষদ্বারা ব্যক্তিগতভাবে প্রকাশ করা হবে।”
আইনগত প্রতিকার ও উত্তরণের উপায়
• সাধারণত, জোরপূর্বক বিবাহের ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাক দেওয়ানি প্রতিকার হিসেবে চাওয়া হয়। এক্ষেত্রে স্ত্রী ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ অনুযায়ী পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের ও বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারবেন। তাছাড়া-
• ফৌজদারী কার্যবিধি- ১৮৯৮ এর ধারা-৪৯১ অধিনে বন্দিপ্রদর্শন (হেবিয়াসকর্পাস) এর আবেদন, ধারা- ৫৫২ এর অধিনে অপহৃত কোন নারীকে পুনরুদ্ধারের আদেশ এবং ধারা-১০০ এর বেআইনিভাবে আটক ব্যক্তির জন্য তল্লাশির আদেশ এর (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) প্রতিকারের মাধ্যমে হুমকি বা জোরপূর্বক বিবাহের সম্মুখীন ব্যক্তিদের পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করার জন্য ফৌজদারি আইন সবচেয়ে কার্যকর।
• দন্ডবিধি- ১৮৬০, ধারা-৩৬৬ এর অধিনে সংঘটিত অপহরণসহ জোরপূর্বক বিবাহের অপরাধের প্রতিকারের আবেদন করা যাবে।
পরিশেষে, শুধুমাত্র আইনের মাধ্যমে এ পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা কমিয়ে আনা যাবে না বা সম্ভব নয়। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধ, পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ন্যায় ভিত্তিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও নাগরিক কর্তৃক সম্মান প্রদর্শন।
লেখক: অ্যাডভোকেট; জেলা ও দায়রা জজ আদালত, চট্টগ্রাম।