দীপজয় বড়ুয়া : রাষ্ট্র ও সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যই আইন প্রণয়ন করা হয়। অপরাধীকে শাস্তি ও নিরপরাধকে মুক্তি ও ক্ষতিপূরণের মাধ্যমেই সমাজে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাই আইনের উদ্দেশ্য। সমাজে অনেকেই আছেন যারা শান্তি ও ন্যায়বিচারের জন্য হুমকি স্বরূপ। কিন্তু তারাও সমাজের অংশ। সবাইকে নিয়েই রাষ্ট্র ও সমাজ। কিন্তু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই অনেক ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে ভবিষ্যতে কোনো ক্ষতিকর কাজ করা থেকে নিবৃত্ত করার জন্য আটকাদেশ দেওয়া হয়। জনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্যই এ বিধান। এতে করে রাষ্ট্র আগাম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে রক্ষা পেতে পারে।
নিবর্তনমূলক আটক আইনের পটভূমি
নিবর্তনমূলক আটক আইন হল নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক যেকোন ব্যক্তিকে কোনো অভিযোগ গঠন ব্যতীত ও বিনাবিচারে আটক রাখার বিশেষ আইন। আপাত দৃষ্টিতে এসব আইন প্রচলিত ফৌজদারি আইনের মতোই। ফৌজদারি আইনে আটক রাখার যেসব বিধান রয়েছে, আটক আইন সাধারণত সেসব ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হয়। নিবর্তনমূলক আটক আইনের তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
প্রথমত, এটি শুধুই আটক, কারাদন্ড নয়;
দ্বিতীয়ত, এটি আদালত কর্তৃক বিচার বা তদন্ত ব্যতিরেকে নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক আটক, এবং
তৃতীয়ত, এটি নিবর্তনমূলক, কোনো দন্ড নয়। অর্থাৎ এ আইন হচ্ছে বিনা শাস্তিতে কাউকে আটক রাখার ক্ষমতা।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের গোড়ার দিক থেকেই ব্যবহারিক অর্থে নিবর্তনমূলক আটক আইনের ধারণাটি প্রচলিত ছিল বলে মনে হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় ব্রিটিশ আমলের কতিপয় অমীমাংসিত সমস্যা থেকে যায়, যেজন্য ভারত ও পাকিস্তান নিবর্তনমূলক আটক আইন বলবৎ রাখে। পাকিস্তান নিজ সংবিধান প্রণয়নের অনেক আগেই এ আইন বলবৎ করে। পাকিস্তানে গৃহীত নিবর্তনমূলক আটক আইনের অধিকাংশই বাংলাদেশ বহাল রাখে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক বাংলার রাজস্ব আদায়ের (দেওয়ানি) ক্ষমতা লাভের পর বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে তাদের সর্বাত্মক কর্তৃত্ব বিস্তার থেকেই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠা। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট এবং ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন সুনির্দিষ্টভাবে নিবর্তনমূলক আটক আইন হিসেবে বিবেচ্য না হলেও সেগুলো সরাসরি স্থানীয় জনগণের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছিল।
প্রথমবারের মতো যেসব আইনে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান ছিল সেগুলি হলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অ্যাক্ট ১৭৮৪ এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অ্যাক্ট ১৭৯৩। বেঙ্গল স্টেট অফেন্সেস রেগুলেশন অ্যাক্ট ১৮০৮ অনুযায়ী জারিকৃত সামরিক শাসন ১১৮ বছর বলবৎ ছিল। ১৯২২ সালে অপর একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে তা বাতিল করা হয়। ফরেন ইমিগ্রেন্টস রেগুলেশন ১৮১২ আইনে শুধু বিদেশিদের আটকের বিধান থাকলেও কয়েক প্রজন্ম ধরে বাংলায় বসবাসরত লোকদের ক্ষেত্রেও এটি প্রয়োগ করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জারিকৃত বেঙ্গল প্রিজনার্স রেগুলেশন ১৮১৮ আইনে নিবর্তনমূলক আটকের বিশেষ বিধান রাখা হয়েছিল। এটাই ছিল যথার্থ নিবর্তনমূলক আটক আইন যা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল।
১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি সীমিত নিবর্তনমূলক আটকের ক্ষমতাসহ বিধিবদ্ধ হলেও পরবর্তী পর্যায়ে প্রণীত ইন্ডিয়া অর্ডিন্যান্স ১৯১৪ এবং ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট ১৯১৫ অভিন্ন উদ্দেশ্য পূরণে ব্যাপকতর ক্ষমতা লাভ করে। তৎকালীন ভারতের স্বাধীনতার ক্রমবর্ধমান দাবির প্রেক্ষিতে নৈরাজ্য ও বিদ্রোহ দমন আইন ১৯১৯ প্রণীত হলে পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তারা সম্ভাব্য অপরাধ সংঘটন থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে সন্দেহভাজন যেকোন ব্যক্তিকে সীমিত সময়ের জন্য আটক রাখতে পারত।
গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট ১৯১৯ এবং গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট ১৯৩৫ ছিল নিবর্তনমূলক আটকের বিধানসহ অন্তর্বর্তীকালীন আইন। ১৯৩৫ সালের আইনটি ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগ পর্যন্ত বলবৎ ছিল এবং পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালের নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পূর্ব পর্যন্ত কার্যকর ছিল। বেঙ্গল স্পেশাল পাওয়ার্স অর্ডিন্যান্স ১৯৪৬ আইনেও নিবর্তনমূলক আটকের বিধান ছিল। প্রকৃতপক্ষে এ অধ্যাদেশই পরবর্তীকালে পাকিস্তানি আইনে পরিণত হয় ইস্ট বেঙ্গল টেম্পোরারি অ্যানেক্টমেন্ট অ্যান্ড রিঅ্যানেক্টমেন্ট অর্ডিন্যান্স ১৯৪৯-এর মাধ্যমে এবং এতে নিবর্তনমূলক আটকের ধারা অক্ষুণ্ণ ছিল। এই অর্ডিন্যান্সের স্থলবর্তী হয় ১৯৪৯ সালের ইস্ট বেঙ্গল প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন অর্ডিন্যান্স।
ইতোমধ্যে নিবর্তনমূলক আটক আইনের ধারাসহ পাকিস্তান পাবলিক সেফটি অর্ডিন্যান্স ১৯৪৯ পাস হয় এবং এতে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান রাখা হয়। এরপরেই নিবর্তনমূলক আটকের ব্যাপক ক্ষমতাসহ ইস্ট বেঙ্গল পাবলিক সেফটি অর্ডিন্যান্স ১৯৫১ জারি হয়। পরবর্তী সময়ে একই উদ্দেশ্যে জারি হয় সিকিউরিটি অব পাকিস্তান অ্যাক্ট ১৯৫২। ১৯৫৩ সালে লাহোরে সামরিক আইন জারি হয় এবং ঘোষণাপত্রে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান ছিল।
১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রেও নিবর্তনমূলক আটকের বিধান অক্ষুন্ন থাকে। কিন্তু এটা ছিল স্বল্পস্থায়ী, কারণ ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয়। সামরিক প্রশাসন নিবর্তনমূলক আটকের বহু আদেশ জারি করে এবং একই উদ্দেশ্যে একই বিধান সংবলিত ইস্ট পাকিস্তান পাবলিক সেফটি অর্ডিন্যান্স ১৯৫৮ জারি করা হয়। এ অধ্যাদেশ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও চালু ছিল, যদিও সংবিধানের ২৬(১) ধারা অনুযায়ী এটি বাতিল বলে গণ্য হওয়ার কথা। কিন্তু বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এটি বহাল ছিল।
পাকিস্তানে নিবর্তনমূলক আটকের বহু ধারা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দীর্ঘস্থায়ী বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার আটকের ব্যাপকতর ক্ষমতাসহ পাকিস্তান ডিফেন্স অর্ডিন্যান্স ১৯৬৫ জারি করে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে গণবিক্ষোভের মুখে ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য হন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান স্বভাবতই ১৯৬৯ সালে সামরিক আইন জারি করেন যাতে নিবর্তনমূলক আটকের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পায়।
ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক-রাজনৈতিক ও আইনগত পরিস্থিতি এত দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে। তবে যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসক রেগুলেশন নং ৭৮ জারি করে যাতে ছিল নিবর্তনমূলক আটকের ব্যবস্থা এবং যুদ্ধের প্রায় শেষ পর্যায়ে একই উদ্দেশ্যে জারি হয় পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ ১৯৭১।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে নিবর্তনমূলক আটক আইনের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার কোনো বিধানও সংবিধানে ছিল না। কিন্তু সংবিধান (দ্বিতীয় সংশোধনী) অ্যাক্ট ১৯৭৩ মোতাবেক সংবিধানের ২৬ ও ৩৩ অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান চালু করা হয়। অধিকন্তু, জরুরি অবস্থার প্রেক্ষিতে সংবিধানে একটি নতুন অংশ ৯এ সংযোজিত হয়। এ সময় সংবিধানের ৩য় অংশে বর্ণিত জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করা যেত।
কৌতূহলোদ্দীপক যে, তখনও যেকোন ব্যক্তিকে আটকের জন্য ইস্ট পাকিস্তান পাবলিক সেফটি অর্ডিন্যান্স ১৯৫৮ এবং বাংলাদেশ সিডিউল্ড অফেন্সেস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার ১৯৭২ স্বল্পকাল বলবৎ ছিল। বর্তমানে যে একটিমাত্র আইনে নিবর্তনমূলক আটক আইনের ধারা রয়েছে সেটি হলো বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪।
অতীতে যদি কেউ কোনো ক্ষতিকর কাজ করে অর্থাৎ ক্ষতিকর কাজ যদি ইতোমধ্যেই করা হয়ে থাকে এবং ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি না হওয়ার আশঙ্কা থাকে তবে সেক্ষেত্রে আটকাদেশ প্রদান করা হলে এটি আইনের দ্বারা সমর্থন করা যায় না।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদের ৪ উপ অনুচ্ছেদে বিধৃত হয়েছে যে, নিবর্তনমূলক আটকের বিধান সংবলিত কোন আইন কোন ব্যক্তিকে ৬(ছয়) মাসের অধিককাল আটক রাখার ক্ষমতা প্রদান করবে না, যদি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক রয়েছে বা ছিলেন কিংবা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্যতা রাখেন এইরূপ দুইজন এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত একজন প্রবীণ কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত কোন উপদেষ্টা পরিষদ উক্ত ৬ (ছয়) মাস অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে তাকে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দানের পর রিপোর্ট প্রদান না করে পরিষদের মতে উক্ত ব্যক্তিকে তদতিরিক্ত কাল আটক রাখার পর্যাপ্ত কারণ রয়েছে।
৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, নিবর্তনমূলক আটকের বিধান সংবলিত কোন আইনের অধীন প্রদত্ত আদেশানুযায়ী কোন ব্যক্তিকে আটক করা হলে আদেশ দানকারী কর্তৃপক্ষ তাকে যথাসম্ভব শীঘ্র আদেশ দানের কারণ জ্ঞাপন করবেন এবং উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রকাশের জন্য তাকে যত সত্বর সম্ভব সুযোগ দান করবেন।
তবে শর্ত থাকে যে, আদেশ দানকারী কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় তথ্যাদি প্রকাশ জনস্বার্থে বিরোধী বলে মনে হলে অনুরূপ কর্তৃপক্ষের বিবচনায় তথ্যাদি প্রকাশে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতে পারবেন। ৬নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, উপদেষ্টা পরিষদ কর্তৃক এই অনুচ্ছেদের ৪নং উপ অনুচ্ছেদের অধীনে তদন্তের জন্য অনুসরণীয় পদ্ধতি সাংসদ আইন দ্বারা নির্ধারণ করতে পারবেন।
বিশেষ ক্ষমতা আইন
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২(চ) ধারায় বর্ণিত রাষ্ট্রীয় শান্তি শৃংখলা বিঘ্নিত “ক্ষতিকর কার্য”(Prejudicial Act) সংঘটন হলে, সরকার উক্ত ক্ষতিকর কার্য হতে নিবৃত করার জন্য কোন ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের আটকাদেশ প্রদান করতে পারে। সরকার এই আইনের ৩ ধারা অনুসারে যে আটকের আদেশ প্রদান করে থাকে, তাই হলো নিবর্তনমূলক আটক। বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২(চ) ধারা অনুসারে “ক্ষতিকর কার্য” হলো এমন কোন কাজ যা-
(১) বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বা প্রতিরক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে;
(২) বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ক্ষতিগ্রস্ত করবে;
(৩) বাংলাদেশের নিরাপত্তার বা জনশৃংখলার ক্ষতিগ্রস্থ করবে;
(৪) সাম্প্রদায়িক শত্রুতার মনোভাব সৃষ্টি করে বা উহার উসকানি দেয়;
(৫) আইন প্রশাসনের কাজে হস্তক্ষেপ করে;
(৬) জনগণের মধ্যে ভীতি বা সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে;
(৭) রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে;
(৮) রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কিংবা আর্থিক স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্থ কর।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে যে, “সরকার কোন লোক সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তাকে কোন ক্ষতিকর কাজ করা হতে নিবৃত করার জন্য আটক করার আদেশ দান করতে পারে এবং সরকার কর্তৃক পরবর্তী কোন আদেশ না হওয়া পর্যন্ত উক্ত আটকের আদেশ ৩০ (ত্রিশ) দিনের বেশি বলবৎ থাকবে না”।
এই আইনের ৮(২) ধারা অনুযায়ী আটককৃত ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ১৫ দিনের মধ্যে তার আটকাদেশের ভিত্তি ও কারণ জানাতে হবে যাতে তিনি এই আদেশের বিরুদ্ধে তার লিখিত অভিযোগ জানাতে পারেন। কিন্তু ৮(১) ধারায় আবার বলে দেয়া হয়েছে, কর্তৃপক্ষ যদি মনে করেন, যে কোনো তথ্য প্রকাশ করলে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হবে, তাহলে তারা সেই তথ্য জানাতে বাধ্য নয়।
তার মানে আটককৃত ব্যক্তি তাকে আটক করার কারণ জানতে পারবে কিনা তাও সরকারের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। এই আইন ব্যবহার করে সরকার ইচ্ছামত যে কোনো নাগরিককে আটক করেই বলতে পারে যে, এই ব্যক্তি ক্ষতিকর কাজ করতে পারে মর্মে সরকার সন্তুষ্ট। সব সরকারের আমলেই বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে অসংখ্য মানুষকে বিনা অপরাধে আটক করে রাখা হচ্ছে।
আইনটির ১০ ধারায় বলা হয়েছে যে, আটক করার ১২০ দিনের মধ্যে আটকাদেশটি ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি অ্যাডভাইজরি বোর্ডের সামনে পেশ করা হবে। এই বোর্ডের দুইজন সদস্য হবেন হাইকোর্টের বিচারপতি হওয়ার যোগ্য নাগরিক আর অপরজন হবেন একজন জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা, যারা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। বোর্ডে যে শুনানি হবে তাতে আটক ব্যক্তি কোনো আইনজীবীর মাধ্যমে বক্তব্য পেশ করতে পারবেন না।
আটকের ১৭০ দিনের মধ্যে বোর্ড সরকারের কাছে রিপোর্ট জমা দেবে। এই রিপোর্টে আটক রাখার পক্ষে মতামত দেয়া হলে সরকার যত দিন খুশি ওই ব্যক্তিকে আটক রাখতে পারবে, তবে বোর্ড প্রতি ৬ মাসে একবার করে আটকাদেশটি রিভিউ করবে। এসব রিভিউতে আটক রাখার পক্ষে মতামত দেয়া হলে একজনকে এভাবে সারাজীবন ধরে বিনা বিচারে আটক করে রাখা সম্ভব। ১৩ ধারার অধীনে সরকার যে কোনো সময় আটকাদেশ প্রত্যাহার করতে পারবে।
নিবর্তনমূলক আটক আইনে অর্থাৎ বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক কিছু মামলায় উচ্চ আদালত যে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন তার কতিপয় নিম্নে উল্লেখ করা হলাঃ
40 DLR 193- মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “বিশেষ ক্ষমতা আইন শুধুমাত্র কোন্ ব্যক্তিকে নাশকতা বা ক্ষতিকর কাজের জন্য আটকের অনুমোদন করে। জননিরাপত্তার জন্য আটকাদেশ প্রদান বিধি সম্মত নয়।”
44 DLR 312 Mstafizur Rahman Vs. Bangladesh- মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “আদালত ঘটনার প্রেক্ষাপট হতে পরীক্ষা করে দেখবেন যে, কোন ব্যক্তির আটক জনস্বার্থে ক্ষতিকর কিংবা নাশকতামূলক কাজ হতে নিবৃত করার জন্য প্রয়োজন, তাহলে উক্ত ব্যক্তিকে ভবিষৎ সামাজিক স্বাভাবিক জীবন যাপনে বিঘ্ন সৃষ্টিকর কাজ করা হতে বিরত রাখার জন্য আটক করা যায়।”
31 DLR(AD) 1 Abdul Latif Mirza Vs. Bangladesh- মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “বিশেষ ক্ষমতা আইন আটককারী কর্মকর্তাকে নাশকতামূলক কাজের জন্য কোন ব্যক্তিক আটক করার ক্ষমতা প্রদান করে । শাসনতন্ত্র হাইকোর্টকে কোন ব্যক্তির আটকাদেশ আইনানুগ অধিক্ষেত্রের মধ্যে সাধিত হয়েছে কিনা এটি পরীক্ষা করার ক্ষমতা প্রদান করেছে।”
1 BLC(HCD) 69- মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “জেলা ম্যাজিষ্ট্রট কিংবা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট কর্তৃক ৩০ দিনের আটকাদেশে সরকারের কোন অনুমতির প্রয়োজন হয় না। তবে আটকাদেশ ৩০ দিনের অধিক হলে সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হবে।”
42 DLR 457; 10 BLD 367 – মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩ ধারার বিধান অনুসারে, কোন আটকাদেশের বিষয় জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট বা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আটকের কারণ উল্লেখে সরকারের নিকট প্রেরণ করলে এবং সরকার এটি ৩০ দিনের মধ্যে সব কিছু বিবেচনা করে আটকাদেশ বর্ধিত না করলে, ৩০ দিন অতিবাহিত হবার পরেও কোন ব্যক্তিকে আটকাবদ্ধ করে রাখা হলে তা বে-আইনী এবং এক্ষেত্রে বিক্ষুব্ধ ব্যক্তি Habeas-corpus(হাইকোর্ট বিভাগে রীট আবেদন) এর আশ্রয় নিতে পারে।
55 DLR 224 -মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারী আদালতে কোন মামলার বিচার কার্যক্রম চলা অবস্থায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাকে আটক করা সঙ্গত প্রতীয়মান হলে উক্ত ব্যক্তিকে এই আইনের আওতায় কর্তৃপক্ষ আটকের আদেশ দিতে পারে।”
লেখক : আইনজীবী; জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।
তথ্য কণিকা: আইন শব্দসমূহ-এডভোকেট মোঃ নাসির উদ্দিন, ফৌজদারী কার্যবিধির ভাষ্য- গাজী মোঃ শামসুর রহমান, ফৌজদারী কার্যবিধ-জহিরুল হক, বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার ও রিমান্ড- হাইকোর্টের নির্দেশনা ও বাস্তবতা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট(ব্লাস্ট)।