তাজওয়ার বিন মালেক অর্ণব : দুই জঙ্গি ছিনতাই সামগ্রিক আদালতের নিরাপত্তাব্যবস্থকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। জনমনে এ নিয়ে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে আদালতগুলো কতটুকু নিরাপদ। গত ২০ নভেম্বর ঢাকার আদালত চত্বর থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ও মাইনুল হাসান শামীমকে পুলিশের চোখেমুখে পিপার স্প্রে মেরে ফিল্মি কায়দায় ছিনিয়ে নিয়েছে তাদের দোসররা। ঘটনার দিন মোট চারজনকে ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা ছিল৷ এজন্য তিনটি মোটরসাইকেলও প্রস্তুত ছিল৷ কিন্তু দুইজনকে নিতে পারলেও বাকি দুইজনকে পারেনি৷ তারা একটি মোটর সাইকেলও ফেলে রেখে যায়৷
আদালত সূত্রে জানা যায়, ওই চার জঙ্গিসহ মোট ১২ জন আসামিকে আদালতে নেয়া-আনার জন্য মাত্র তিনজন কনেস্টবল দায়িত্বে ছিলেন৷ আদালতের কাজ শেষে সিএমএম আদালতের হাজতখানায় নেওয়ার পথে ওই চার জঙ্গির সঙ্গে ছিল মাত্র একজন কনেস্টবল। তাদের নিরাপত্তা ছিল খুবই ঢিলেঢালা, দেখা যায়নি বাড়তি কোন ব্যবস্থা ৷ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি এবং সাধারণ আসামিদের একই সঙ্গে আনা হয় সেদিন ৷ জঙ্গিদের মাত্র এক হাতে হ্যান্ডকাফ ছিল৷ কোনো ডান্ডাবেড়ি পরানো ছিল না৷
জঙ্গি ছিনতাই ঘটনা এবারই নতুন নয়, এর আগেও ঘটেছে। ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মাত্র চারজন পুলিশ পাহারায় প্রিজন ভ্যানে কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহ আদালতে নেওয়ার পথে ত্রিশাল ও ভালুকার মাঝামাঝি সাইনবোর্ড এলাকায় ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে দণ্ডপ্রাপ্ত তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়েছিল তাদের সহযোগীরা। নজিরবিহীন সেই ঘটনায় প্রাণ হারাতে হয়েছিল প্রিজন ভ্যানে থাকা এক পুলিশ সদস্যের। তিনজনের একজনকে পুলিশ স্থানীয় মানুষের সহায়তায় আটক করতে পেরেছিল। কিন্তু বিগত আট বছরে পুলিশের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে বাকি দুজন।
এইতো কিছুদিন আগে- ২০১৯ সালে নভেম্বর মাসেই হলি আর্টিজান হামলা মামলার রায়ের দিন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী রাকিবুল হাসান রিগ্যান আদালতে হাজির হয়েছিল আইএস- এর টুপি পরে। প্রশ্ন উঠেছিল, কী করে আসামিদের কাছে আইএসের প্রতীক সংবলিত টুপি এলো?
ডান্ডাবেড়ি ছাড়া তো বটেই এমন দুটি স্পর্শকাতর হত্যামামলার আসামিকে নিরাপত্তাহীনভাবে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে নেওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এ ঘটনাগুলোর পিছনে নিশ্চয়ই বড় ধরণের গাফলতি ছিল এবং এর দায় কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারেনা।
যেকোন প্রকার জঙ্গি হামলা ঠেকাতে, জঙ্গিদের নিশ্চিহ্ন করতে সরকারের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা সহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জঙ্গি ধরতেও আমরা সক্ষম। কিন্তু আমাদের এই সক্ষমতা গুড়ে বালি হয়ে যায় যখন এসব দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের তথাকথিত নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। কারণ জঙ্গি নির্মূল প্রক্রিয়াটি শুধুমাত্র গ্রেফতার অবদি সীমাবদ্ধ নয়, বিচার এবং রায় বাস্তবায়নের ধাপ পেরিয়ে এর সমাপ্তি- এটি হয়তো ভুলে যাচ্ছি।
ফলে লক্ষ্য করা যায় বহু পরিকল্পনা, মেধা, শ্রম, জীবনবাজি রেখে জঙ্গিদের ধরার পরেও বিচারকার্যে জঙ্গিদের আনা নেওয়া কিংবা হাজিরের ক্ষেত্রে সাদামাটা আয়োজন। সেই সাথে রয়েছে পর্যাপ্ত মনিটরিং এর অভাব। যেখানে বাংলাদেশ সরকার সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে সেখানে ঘটনাগুলো সার্বিক সরকারের জঙ্গি মোকাবেলার সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
শুধু জঙ্গি নয়, পুলিশ হেফাজত থেকে আসামিদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা এখন প্রায় নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এতোগুলো চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটার পরেও কেন আদালতে আইনশৃঙ্খলার এতো অপর্যাপ্ততা? এতে একদিকে বিচারক, আইনজীবীরা যেমন শঙ্কিত ঠিক অন্যদিকে আদালতে আসা বিচারপ্রার্থীরা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন।
জঙ্গি হামলা দমন এবং সন্ত্রাস বিরোধী কার্যক্রম বিচারের জন্যে সরকার ২০০৯ সালে সন্ত্রাস বিরোধী আইন প্রণয়ন করেছে যার অধীনে বিশেষ আদালত স্থাপন করা হয়েছে যেটি সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল নামে পরিচত ৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে এ বিশেষ আদালতের জন্য নেই তেমন উল্লেখযোগ্য নিরাপত্তাব্যবস্থা। সাধারণত সরকারের পক্ষ থেকে কোন বড় মাপের ঘটনা ঘটার পরই নানারকম কার্যকলাপ হাতে নিতে দেখা যায়। এই দুই দুর্ধর্ষ আসামির ছিনতাইয়ের পরও ভিন্নটি হয়নি।
ঘটনার পর পরই সরকারকে নড়ে চড়ে বসতে দেখা গিয়েছে। আদালত পাড়ায় কড়াকড়ি, বিভিন্ন সীমান্তে নজদারি বাড়ানো, পুলিশের ১০ লাখ করে দুই জঙ্গির জন্য পুরস্কার ঘোষণা, পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন, সাড়াশি অভিযান পরিচালনা সহ জঙ্গিদের ডান্ডাবেড়ি ছাড়া আদালতে না পাঠানোর বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা এসেছে। এছাড়া এ ঘটনার পর সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের আদালতে হাজির না করে ভার্চুয়ালি বিচার কার্যক্রম চালানোর জন্যে সরকারের উচ্চ মহল থেকে পরিকল্পনা চলছে। কিন্তু প্রশ্ন বরাবরে মতো রয়ে যায় সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্যে এ উদ্যোগগুলোই কি যথেষ্ট?
অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো যেন ভবিষ্যতে না ঘটে প্রয়োজন সমস্যাগুলি চিহ্নিত করে দীর্ঘমেয়াদী ও কার্যকরি সমাধান খুঁজে বের করা। প্রথমত আদালতটি যেখানে স্থাপিত হয়েছে সেটি রাজধানীর জনস্বীকৃতি একটি লোকালয়পূর্ণ জায়গা। পাশাপাশি আরো অনেকগুলো আদালত রয়েছে সেখানে। জঙ্গি ছিনতাইকারীরা ভীড়পূর্ণ জায়গাটির পুরো সুযোগটাই যে নিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ ঢাকার এই আদলতপাড়াটিতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে।
যেহেতু জঙ্গি দমন রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং খুবই সংবেদনশীল একটি বিষয় সেখানে এই বিশেষ আদালত স্থাপন করা যেতে পারতো পৃথক জায়গায়। সাধারণত অন্যান্য আদালত থেকে আলাদা যেমনটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, ট্যাকসেস আপীলাত ট্রাইবুনাল, প্রশাসনিক আপীল ট্রাইব্যুনাল, শ্রম আদালত সমূহ স্থাপিত রয়েছে পৃথক জায়গায়।
এছাড়া পূর্বেও নিরাপত্তা বিবেচনায় এবং মামলা পরিচালনার প্রয়োজনে পিলখানা বিডিআর বিদ্রোহ হত্যা মামলা এবং বেগম খালেদা জিয়ার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচারিক আদলতসমূহকে পৃথকভাবে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসায় স্থাপন করা হয়েছিল। বিচারসংশ্লিষ্ট বিষযগুলির সুবিধার্থে হয়তো সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইবুনালকে অন্যান্য আদালতের মতো একই আদালত এলাকায় রাখা হয়েছে। কিন্ত ক্রমাগত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিরাপত্তার বিষয়টিকে আরো বেশি জোরদার করে তুলেছে।
সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ ধারা ২৮(৬) অনুসারে পৃথক জায়গায় আদলত আসন গ্রহণ এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে আইনগত কোন বাধা নেই। বর্তমানে ঢাকার সন্ত্রাস দমন ট্রাইবুন্যালটি সিজেএম কোর্টের ৭ম তালায় অবস্থিত। যেহেতু ঢাকার আদালত পাড়া অন্যান্য জেলার আদালত থেকে অধিক ব্যস্ত, মামলার সংখ্যাও এখানে তুলনামূলক বেশি এবং একই সাথে চাঞ্চলকর জঙ্গি মামলাগুলো এই বিশেষ আদালতে বিচার হয়ে থাকে সেহেতু প্রাথমিক আবস্থায় সিজেএম কোর্ট ভবন থেকে স্থানান্তর করে কাশিমপুর অথবা উত্তরার কাছাকাছি যেখানে আসামি আনা নেওয়ায় সুবিধা হয় এমন জায়গায় গঠন করা যেতে পারে, যেন অধিকতর নিরপত্তা নিশ্চিত হয়।
এছাড়া বর্তমানে রাজধানী ঢাকা ব্যাতিত সারাদেশে আরো ৬টি সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। উক্ত আদালতসমূহ সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা ও দায়রা জজআদালত এলাকায় অবস্থিত রয়েছে। এখানে আবারো মনে রাখা প্রয়োজন জঙ্গি ছিনতাইয়ের প্রথম সূত্রপাতটি কিন্তু ঘটেছে ঢাকার বাইরে মংমনসিংহের ত্রিশালে সে ক্ষেত্রে ঢাকার বাইরেও একপ্রকার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। তাই ধারাবাহিক ভাবে এ আদালতগুলোকেও নিরাপত্তসম্পন্ন জায়গায় স্থানান্তর প্রয়োজন। স্থানান্তরকৃত আদালতসমূহে বিশেষ কোর্ট হাজত, প্রবেশাধিকার সংক্ষিতসহ নিরাপত্তার স্বার্থে সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
এখন আসি এ আসামিদের আনা নেওয়া দায়িত্বটি মূলত কাদের? সাধরণত আদালতে আটককৃত আসামি আনার প্রক্রিয়াটি হলো, যে থানার মামলায় আসামিদের হাজিরা, সেই থানার দায়িত্বরত পুলিশ কারাগারে গিয়ে আসামিদের প্রিজন ভ্যানে করে নিয়ে আসবেন৷ এরপর আদালত এলাকায় এনে প্রসিকিউশন পুলিশের (কোর্ট পুলিশ) নিকট হস্তান্তর করবেন।
তারা প্রথমে আসামিদের কোর্ট হাজতে রেখে তারপর আদালতে হাজির করবেন৷ আদালতের কাজ শেষ হলে তারাই প্রিজন ভ্যানে উঠিয়ে দেবেন৷ এরপর আবার আসামীদের কারাগার পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ নিয়ে গিয়ে কারা কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেবেন৷ প্রতিদিন গড়ে ৫০০-৬০০ আসামি আনা-নেওয়ার পেছনে মাত্র ১৫০ জন পুলিশ সদস্য দায়িত্বরত থাকেন। অর্থাৎ প্রতি ৪ জন আসামির জন্য মাত্র ১ জন পুলিশ যেটি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
অবাক করার বিষয়টি হচ্ছে বিশেষ এই আদালতের আসামিদের জন্য নেই পৃথক কোন ব্যবস্থা। অন্যান্য মামলার আসামীদের মতো এদেরকেও রাখা হয় একই কোর্ট হাজতে। এ সব মামলার আসামিরা সচারচর আক্রমণাত্মক, সশস্ত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, প্রযুক্তির দিক থেকে দক্ষ হয়ে থাকে। তাইতাদের কোর্টে আনা নেওয়ার কিংবা উপস্থাপনের দায়িত্ব অন্যান্য মামলার আসামীদের মতো হয় তাহলে নিরাপত্তার বড় একটি আশঙ্কা বরাবরের মতো রয়ে যায়।
সাধারণত কোন চাঞ্চল্যকর মামলার রায় কিংবা শুনানিতে যে কোন প্রকার নাশকতা রোধে সরকার আদালাতপাড়ায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়ন করে থাকে। কিন্ত এটিও সার্বিক নিরাপত্তার বিবেচনায় পর্যাপ্ত নয়। সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইবুনালসমূহের জন্য প্রয়োজন বিশেষায়িত ফোর্স যারা জঙ্গি মোকাবেলায় অভিজ্ঞ এবং দক্ষ। যেটি বাংলাদেশ পুলিশের আগে থেকেই রয়েছে যেমনটি এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ), কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি), র্যাব, সোয়াট যারা জঙ্গি মোকাবেলায় প্রশংসনীয় ভুমিকা পালন করে আসছে। জঙ্গি আনা নেওয়া থেকে শুরু করে আদালতে হাজির করা সহ নিরাপত্তার সকল দায়িত্ব এসব বিশেষায়িত ইউনিটের উপর ন্যস্ত করা যেতে পারে।
অর্থাৎ প্রসিকিউশন পুলিশ যেটি কোর্ট পুলিশ হিসেবে পরিচিত এবং থানা পুলিশ (জঙ্গি আনা নেওয়ার ক্ষেত্রে) উভয়ের দায়িত্বে থাকবে এসব বিশেষায়িত ইউনিট যেন জঙ্গি ছিনতাই সহ বিভিন্ন নাশকতামূলক ঘটনার পুনঃবৃত্তি না ঘটে। পাশাপাশি প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট বিচারকার্যে সম্পৃক্ত বিচারক এবং মামলার সাক্ষীদের কঠোর নিরাপত্তা প্রদান করা।
যদিও আদালত স্থানান্তর সময়সাপেক্ষ এবং প্রক্রিয়াধীন একটি ব্যাপার। কিন্ত সরকার এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন চাইলে উক্ত আদালতসমূহে পুলিশের এসব বিশেষায়িত ইউনিটকে নিযুক্ত করার উদ্যোগ নিতে পারে। ফলে ট্রাইবুনালের বিজ্ঞ বিচারক, আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা প্রদানসহ সার্বিক ভাবে আদালতের বিচারকার্য পরিচালনা করাটা আধিকতর সহজ এবং গতিশীল হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ।